রমজানের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত - রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় করণীয়

সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই রমজান মাসের জন্য ১১টি মাস অপেক্ষা করে থাকেন। রমজান মাসের ফজিলত ও গুরুত্ব বলে বোঝানো যাবেনা। গুরুত্বপূর্ণ এই মাসের আগমন উপলক্ষে আমাদের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত তাকি জানেন ?

বন্ধুরা আজ আপনাদের সাথে- রমজান মাসের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিতা আলোচনা। যেহেতু ১২টি মাসের মধ্যে রমজানের ফজিলত অনেক বেশি, তাই এই মাসের আগমনের প্রস্তুতিটাও সেই রকম হওয়া উচিত।

সূচিপত্রঃ রমজানের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত।

রাসুল (সাঃ) কিভাবে রমজানের প্রস্তুতি নিতেন
রমজান আগমনে আমাদের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত
রমজান মাসে আমাদের কি করণীয়
রমজান মাসের আমল সমূহ
রমজান মাসে তারাবির নামাজের বিধান কি
লেখকের মন্তব্যঃ

রাসুল (সাঃ) কিভাবে রমজানের প্রস্তুতি নিতেন

নবী করিম (সাঃ) সর্বদা অন্যান্য কাজে নিয়োজিত থাকতেন, তা ভ্রমণ হোক বা অন্যান্য বিষয়, এবং প্রতি মাসের তিন দিন রোজা রাখতেনা। শাবান মাসকে তিনি মেরামত করতেন । বলা হয়েছে যে, তার মহিলারা শাবান মাসে রমযান মাসে তাদের রোযা কাযা করতেন, তাই তিনি এর জন্য রোযা রাখতেন।

নবী (সাঃ) রমজান আসার আগেই তিনি পুরোপুরি প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। নফল ও অন্য ইবাদত বাড়িয়ে দিতেন। রমজানের বরকত ও গুরুত্বের কথা বিভিন্ন সমাবেশে উল্লেখ করতেন এবং রোজা রাখার প্রতি খুবই গুরুত্ব দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রমজান এত ভালোবাসতেন যে প্রায়ই এর জন্য দোয়া করতেন।

রমজান আগমনে আমাদের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত

আমরা রমজানের আগম বার্তা পেলে অন্য ভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। যেমন- রমজানে আমরা কি কি খাবার খাব, কি দিয়ে ইফতারি করবো, পুরো মাসে কতগুলো বাজার লাগবে, পরে দাম বেড়ে যেতে পারে এজন্য আগে থেকেই কেনাকাটার হিড়িক পড়ে যায় আমাদের মধ্যে যা রমজানের পরিপন্থি।

কিন্তু আমাদের প্রস্তুতিটা হওয়া উচিত অন্য রকম। যেমন- রমজানের তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া। শাবান মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি নেওয়া যে, আমরা কি কি আমল করবো, যতই কষ্ট হোনা একটিও রোজা যেন না ভাঙ্গে। কতগুলো মানুষকে ইফতারি করাবো, কত টাকা দান করবো ইত্যাদি।

রমজান মাস পাওয়াটা একজন মুসলমানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সব চেয়ে বড় নেয়ামত। যেহেতু রমজান আসে শুধু মানুষের কল্যাণের জন্য, গুনাহ মাফের জন্য, আত্নশুদ্ধির জন্য, জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য। এই মাসের ফজিলতের কারণে জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, বেহেস্তের দরজা খুলে দেয়া হয়। তাই এই মাসের জন্য প্রস্তুতিও সেই রকম হওয়া উচিত।

রমজান মাসে আমাদের কি করণীয়

প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর রমজান মাসে রোজা রাখা ফরয। এটা রমজান মাসের বিশেষ আমল হলো সকল আদব রক্ষা করে পুরো মাস রোজা রাখা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। এই মাসে বেশি বেশি নফল আমলগুলো করতে হবে। কারণ অন্য মাসের ফরজ আমলের সমতুল্য হচ্ছে রমজান মাসের নফল আমল।

সম্ভব হলে তারাবির নামাজ আদায় করতে হবে। বেশি বেশি দান সদকা করতে হবে। গরিব অসহায় মিসকিন লোকদের সাহায্য করতে হবে। কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করতে হবে বেশি বেশি। অর্থসহ বুঝে পড়ার চেষ্টা করুন। তবে শুধু তেলাওয়াত করলেও অনেক সওয়াব পাওয়া যায়। যারা পড়তে জানেন না তাদের জন্য রমজান হতে পারে কোরআন শিক্ষার উপযুক্ত সময়।

বেশি বেশি তওবা ইস্তেগফার করতে হবে। মাগফিরাত চাইতে হবে আল্লাহর কাছে নিজের সকল গুনাহের জন্য। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা এই মাসে সব চাইতে বেশি মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে থাকেন। সুযোগ থাকলে শেষ দশকে ইতিকাফে বসতে হবে এবং লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে হবে। কারণ এক রাত্রি ইবাদত হচ্ছে হাজার মাসের চেয়েও ‍উত্তম।

রমজান মাসের আমল সমূহ

ইবাদতের মাধ্যমে সব চেয়ে বেশি সওয়াবের অর্জনের মাস হচ্ছে রমজান মাস। এ মাসে অনেক গুলো আমল আছে যেগুলোর প্রতিদান অনেক অনেক বেশি হয় শুধু রমজান উপলক্ষে। তাই এই সুযোগটি হেলায় হারানো একেবারে ঠিক নয়। নিম্নে বিশেষ আমলের মধ্য হতে কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ-

পাপ কাজ বর্জন করুনঃ- শুধু রাসা দিন না খেয়ে থাকলাম এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকলাম রোজা হয়ে গেল এমনটি নয়। সঠিক নিয়মে রোজা রাখার পাশাপাশি সব ধরনের পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন- মিথ্যা কথা বলা, গিবত করা, ঝগড়া করা, গালাগালি করা, দৃষ্টির হেফাজত করা, সুদ খাওয়া ও ঘুস গ্রহণকরা থেকে বিরত থাকতে হবে।

এসব কাজ থেকে যারা বিরত থাকে না, হাদিসে বলা হয়েছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পাপ কাজ, মিথ্যা বলা, অন্যায় কাজ করা ও মূর্খতাসুলভ কাজ ত্যাগ করতে পারে না, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লহতায়ালার কোনো প্রয়োজন নেই। (সহিহ বুখারিঃ ১৯০৩)।

কুরআন তেলাওয়াত করুনঃ- রমজানে বেশি বেশি পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। কেননা আল্লাহতায়ালা রমজানের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, রমজান হলো এমন মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। তাছাড়া রমজানে প্রতিটি ভালো আমলকে ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

নফল নামাজে মনোনিবেশঃ- রমজান মাসে রোজা রাখার পাশাপাশি কিয়ামেও সময় অতিবাহিত করতে হবে, অর্থাৎ নফল নামাজ আদায় করা। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজানে (রাতের বেলা নফল) নামাজে দাঁড়িয়ে থাকে, ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় তার পূর্বের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারিঃ ৩৭)।

অন্য হাদিসে কিয়ামুল লাইল তথা রাতের নামাজের আদেশও দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তারাবির নামাজ আর এর চূড়ান্ত পর্যায় হলো তাহাজ্জুদের নামাজ। তাই আমাদের উচিত গুরুত্বের সঙ্গে রাতে তারাবির নামাজ আদায় করা অথবা তাহাজ্জুদের নামাজ এবং অন্যান্য নফল নামাজ বেশি বেশি পড়া।

খালেস মনে দোয়া করুনঃ- রমজানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলোর অন্যতম আমল হলো বেশি বেশি দোয়া করা। কেননা হাদিসে বর্ণিত আছে, রমজানে সবচেয়ে বেশি দোয়া কবুল করা হয়। বিশেষ করে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তের দোয়া। তখন নিজের গুনাহগুলোর জন্য ক্ষমা চেয়ে দোয়া করার উপযুক্ত সময়।

এ মাসে আল্লাহতায়ালা ক্ষমার দরজা উন্মুক্ত করে দেন। আল্লাহতায়াল বলেন, যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, তিনি তার গুনাহগুলোকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তার পুরস্কার অনেক বাড়িয়ে দেবেন। (সূরা তালাকঃ ৫)। এই মাসে সব চেয়ে বেশি মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। যা অন্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি।

অন্যকে ইফতার করানোঃ- আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাকঃ ৭৯০৬)। অন্য রোজাদারকে ইফতার করানোর মাধ্যমে আমরা কিন্তু সহজেই একটি রোজার সওয়াব পেয়ে যাচ্ছি।

আমরা যারা শহরে থাকি, আমাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ হলো, অনেক মানুষ ইফতারের সময় গাড়ি থেকে নেমে ভালোমন্দ ইফতার করতে পারেন না। আমরা যদি তাদের ইফতারে সহযোগিতা করতে পারি, তাহলেও আমরা এই সওয়াবটি অর্জন করতে পারব। একটুকরা খেজুর অথবা পানি পান করিয়ে হলেও অন্যদের ইফতারি করান।

মুক্ত হস্তে দান করুনঃ- আর রমজানে দানের গুরুত্ব অনেক বেশি। এ মাসকে দানের মাসও বলা হয়, কেননা এ মাসে একটি নফল ইবাদত করলে একটি ফরজের সমান সওয়াব। আর একটি ফরজ ইবাদত করলে ৭০টি ফরজের সওয়াব দেওয়া হয়। রমজানে নবী রাসূল সাহাবায়ে কেরাম এবং সালফে সালেহিনরা প্রচুর পরিমাণে দান করতেন।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ)-এর দান রমজানে এমনভাবে বেড়ে যেত, তা মুক্ত বাতাসের মতো হয়ে যেত। মুক্ত বাতাস যেভাবে সবার কাছে পৌঁছে, ঠিক তেমনি যে চাইত তাকে তিনি দান করতেন, যে চাইত না তাকেও তিনি দান করতেন। দান হচ্ছে অন্য রকম একটি ইবাদত। যা কিনা বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে এবং কিয়ামতের দিন ঢাল হয়ে দাড়াবে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তাঁর বদান্যতা আরও বেড়ে যেত। (সহিহ মুসলিমঃ ৩২০৮)। আর এ মাসে ১ টাকা দান করলে অন্য মাসে ৭০ টাকা দানের সমান সওয়া পাওয়া যাবে। এজন্য একেবারে কম হলেও প্রতিদিন ১ টাকা হলেও দান করুন।

বেশি বেশি জিকির করাঃ- রমজানে বেশি বেশি জিকির-আসকার করাও গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে তূলনামূলক আমরা একটু অবসর থাকি বেশি। তাই অবসর সময়টুকু অপচয় না করে হাঁটতে-বসতে বেশি বেশি জিকিরের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করা উত্তম।

রমজানে আমরা নিম্মোক্ত জিকিরগুলো আদায় করতে পারি। রাসূল (সাঃ) বলেন, সর্বোত্তম জিকির হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তাই আমাদের উচিত, এটা বেশি বেশি পড়া। তারপর বেশি বেশি ইত্তেগফার করা। রাসুল (সাঃ) প্রতিদিন ৭০ এর অধিক ইত্তেগফার করতেন।

এছাড়া ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম’ এ জিকিরগুলো আদায় করতে পারেন। এসব জিকিরগুলো সব সময় মুখে উচ্চারণ করতে থাকুন। প্রথম দিকে একটু সমস্যা মনে হলেও পরে কিন্তু সহজ হয়ে যাবে।

রমজান মাসে তারাবির নামাজের বিধান কি

এই রমজানে রোজা রাখার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো তারাবি নামাজ। রমজানের রাতে এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নতের পর এবং বেতর নামাজের আগে দুই রাকাত করে তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। তারাবির নামাজ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তবে মক্কা ও মদিনাতেও বর্তমানে ৮ রাকাত তারাবিহ্‌ পড়া হয়।

একদল বলছেন, তারাবির নামাজ ২০ রাকাত, অন্য দল বলছেন ৮ রাকাত। তবে রাসুল (সাঃ) কোন দিন ২০ রাকাত তারাবিহ্‌ পড়েননি। এ মর্মে হাদিসে পাওয়া যায় যে, আয়শা (রাঃ) বলেছেন রাসুল (সাঃ) রমজান মাসে এবং রমজানের বাইরে রাতে ১১ রাকাতের বেশি নামাজ পড়তেন না। আমলের দিন থেকে তার থেকে আমরা অবশ্যয় বেশি করতে পারবো না।

তারাবির নামাজ কিন্তু ফরজ নয়। তবে অনেক বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। রাসুল (সাঃ) তিন দিনের বেশি তারাবিহ পড়েননি রোজার মাসে। তিনি সারা মাস পড়েননি ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। সহিহ বর্ণনা মতে তারাবিহ্ এবং তাহাজ্জুত কিন্তু একই নামাজ। অর্থাৎ এশার নামাজের পর পড়লে তারাবিহ্‌ এবং শেষ রাতে পড়লে তাহাজ্জুত।

লেখকের মন্তব্যঃ

রমজান মাস আসার আগে থেকে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জণের জন্য বিভিন্ন ইবাদতের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিব। আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকবো। বেশি বেশি নফল নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জণই হবে আমাদের একমাত্র কাম্য। আল্লাহ হাফেজ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪