সরিষা তেলের উপকারিতা ও সয়াবিন তেলের অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন
তেল রান্নার একটি অপরিহার্য উপাদান। তেল ছাড়া যেন রান্না অসম্পূর্ণ। রান্নায় আমরা তেল অবশ্যই ব্যবহার করবো। তবে কোন তেল আমাদের জন্য উপকারি এবং কোন তেল ক্ষতিকর তাকি আমরা জানি ?
হ্যাঁ বন্ধুরা আজ আমরা জানবো সরিষা তেলের উপকারিতা ও সয়াবিন তেলে ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে। এখানে জানতে পারবেন- কোন কোন তেল আমাদের জন্য উপকারি। উপকারি তেল হলেও কতটাকু পরিমান খাওয়া ভালো সে সম্পর্কেও বিস্তারিত জানতে পারবেন।
ভূমিকাঃ
সয়াবিন ও সরিষা তেলের সঙ্গে আমাদের নিত্যদিনের পরিচয়। ইদানীং অন্যান্য ভোজ্য তেলের কদরও বাড়ছে। এগুলোর পুষ্টিগুণও ভিন্ন। কোন তেলে কী পুষ্টিগুণ,কোন তেল উপকারি, কোন তেলে অপকারিতা রয়েছে, প্রতিদিন কতটুকু তেল খাওয়া উচিৎ- জেনে ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
সূচিপত্রঃ
রান্নায় সরিষার তেলের উপকারিতা
সরিষার তেলের অপকারিতা
সয়াবিন তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা
চুলের জন্য সরিষার তেলের উপকারিতা
সরিষার তেল খাওয়ার নিয়ম
ত্বকে সরিষার তেলের উপকারিতা
সরিষার তেল বনাব সয়াবিন তেল
রান্নায় কতটুকু তেল খাওয়া উচিৎ
লেখকের মন্তব্যঃ
রান্নায় সরিষার তেলের উপকারিতা
মুখোরচক রান্নায়, বিভিন্ন ভর্তায় অথবা রকমারি আচারে দীর্ঘদিন যাবৎ সরিষার তেল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শুধু ঝাঁজের বেলায় নয়, মুখের রসনা বাড়াতে খাবারের স্বাদ রাঙাতে, ত্বকের যত্নে, চুলের পরিচর্যায়, এমনকি গাঁটের ব্যথা কমাতে সরিষার তেলের তুলনা নেই। এই তেলের রয়েছে অনেক উপকারি দিক।
এই তেল সাধারণত ভালো চর্বি হিসাবেই পরিচিত। যার মধ্যে ৫৯% মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, ২১% পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ১১% স্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে এবং এর হাই স্মোক পয়েন্ট 480°F, যার ফলে এটি উচ্চতাপেও রান্না করার জন্য কার্যকরী একটি তেল। তাই সার্বিক বিবেচনায় এ তেলের উপকারী দিক থেকে নিজেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করবেন না।
চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, সরিষার তেল মস্তিষ্কের জন্য ভীষণ উপকারি। বিশেষ করে অবসাদ কাটাতে, স্মৃতিশক্তি আর মনঃসংযোগ বাড়াতে এ তেল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সহায়ক। সরিষা তেল ক্যানসার প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। এ তেলে বিদ্যমান মনোআনস্যাচুরেটেড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারি।
সরিষার তেলের অপকারিতা
উন্নত বিশ্বের কিছু দেশ সরিষার তেলেও ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কারণ, এ তেলে প্রায় ২০-৪০ শতাংশ এরিউসিক অ্যাসিড আছে যা শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইড তৈরি করে। যার কারণে হৃদপিণ্ডে মারাত্মক ক্ষতি হয়। এছাড়াও ফুসফুসের ক্যানসার ও এনিমিয়ার জন্যও এটি দায়ী। তবে ভারতের ডাক্তারেরা সরিষার তেল খাওয়ার পরামর্শ দেন।
এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘকাল ধরে এরিউসিক অ্যাসিড প্রবেশ করলে সেটি হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে এক ধরনের রোগের সৃষ্টি করে, যার নাম মায়োকার্ডিয়াল লিপিডোসিস। যদিও সরাসরি মানব শরীরে এ নিয়ে কোনো ধরনের গবেষণা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে কারো শরীরে অল্প মাত্রায় এরিউসিক অ্যাসিড প্রবেশ করলে সেটা নিরাপদ। কিন্তু এর মাত্রা অধিক হলেই সেটি বিপজ্জনক হতে পারে মানব শরীরে।
সয়াবিন তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা
সয়াবিন তেলকে হার্ট-স্বাস্থ্যকর তেল হিসাবে বিবেচনা করা হয় কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা -3 এবং ওমেগা -6 ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। যাইহোক, এতে অন্যান্য ক্ষতিকারক যৌগ রয়েছে, যেমন স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রাইগ্লিসারাইড অ্যাসিড, যা প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। বাজারে হরেক রকম সয়াবিন তেল পাওয়া যায়, তবে আসল সয়াবিন তেল শরীরের জন্য খুব উপকারী।
সয়াবিন তেলের উপকারিতা-
- সয়াবিন তেল শরীরর কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
- সয়াবিন তেলের ভিটামিন ই এন্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
- সয়াবিন তেলের ভিটামিন কে হাড়ের বৃদ্ধি ও মজবুত করে।
- সয়াবিন তেলের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড ত্বকের পুষ্টি যোগায়।
- সয়াবিন তেল মেয়েদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- সয়াবিন তেলের প্রোটিন মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- সয়াবিন তেলের ক্যালসিয়াম দাঁত ও মাড়িকে মজবুত করে।
- সয়াবিন তেলের আঁশ হার্ট ও লিভারকে সচল রাখে।
- সয়াবিন তেল শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের যোগান দেয়।
- সয়াবিন তেলের আইসোফ্ল্যাবনস মেনোপজের লক্ষন ও প্রস্টেট ক্যান্সার রোধ করে।
সয়াবিন তেলের অপকারিতা-
- সয়াবিন তেল অতিরিক্ত খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
- হৃদরোগ ও ক্যান্সারের জন্যও অতিরিক্ত সয়াবিন তেল দায়ী।
- সয়াবিন তেল এ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্টস হিসেবে কাজ করে।
চুলের জন্য সরিষার তেলের উপকারিতা
চুলের যত্নের ক্ষেত্রে, চুলের স্বাস্থ্য এবং বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আনতে পারে সরিষার তেল। সরিষা গাছের বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল, বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এর অসংখ্য স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আগেকার দিনে মেয়েদের চুলে শুধুমাত্র সরিষার তেল ব্যবহার করত, সেই সময় তাদের চুলও অনেক ভালো ছিল।
সরিষার তেলে রয়েছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এর উচ্চ মাত্রা রয়েছে ওমেগা 3 এবং ওমেগা -6 ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা স্বাস্থ্যকর চুল বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই পুষ্টির উপস্থিতি মাথার ত্বকে পুষ্টি জোগাতে, চুল পড়া কমাতে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
শুষ্ক এবং ভঙ্গুর চুল বিভক্ত প্রান্ত এবং ভাঙ্গা হতে পারে। সরিষার তেল প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে, চুলে গভীর হাইড্রেশন প্রদান করে। এর ইমোলিয়েন্ট বৈশিষ্ট্যগুলি আর্দ্রতা লক করতে, চুলকে নরম, চকচকে এবং আরও পরিচালনাযোগ্য করতে সাহায্য করে। সরিষার তেল নিয়মিত ব্যবহার করলে শুষ্কতা প্রতিরোধ করা যায় এবং চুল ভালো রাখতে পারে।
সরিষার তেল খাওয়ার নিয়ম
আপনি অনেক ভাবেই সরিষার তেল খেতে পারেন। প্রতি দিনের রান্না থেকে শুরু করে সর্দি, কাশি বা ঠান্ডা জনিত সমস্যার সমাধানের কার্যকর। এমন কি অনেক ব্যাথা বা ত্বক ও চুলের যত্নে সরিষার তেল আপনি মেখেও ব্যবহার করতে পারেন। প্রতিদিনের রান্নায় সরিষার তেলের ব্যবহার প্রধান উপকরন হিসাবে সরিষার তেল হবে আপনার জন্য কার্যকর।
কারন এই তেল যেমন খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে দেয় তেমনি স্বাস্থ্যকর করে। যে কোন ভাজি, তরকারী, বিরিয়ানী, ফাস্ট ফুড রান্না থেকে শুরু করে যে কোন রান্নায় সরিষার তেল ব্যবহার করতে পারেন। এতে আপনার খাবারের স্বাদ যেমন ইউনিক ও আরো বাড়বে তেমন আপনার শরীরের জন্য উপকারী হবে।
ত্বকে সরিষার তেলের উপকারিতা
শীত আসতেই ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়েছে কমবেশি সবার। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যায়, ফলে ত্বক ফাটে ও কালচে হয়ে যায়। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাইলেই কিন্তু ঘরে থাকা সরিষার তেল ব্যবহার করে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। অনেকেরই ভুল ধারণা আছে, সরিষার তেল মাখলে ত্বক কালচে হয়ে পড়ে।
তবে এ ধারণা একেবারে ভুল। বরং ত্বকের পরিচর্যা করার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে সরিষার তেল। সরিষার তেলের মধ্যে থাকে ফ্যাটি অ্যাসিড ও একাধিক প্রয়োজনীয় পুষ্টি। এই তেল ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে। সরিষার তেল ব্যবহারে ত্বক নরম হয়ে ওঠে। শুষ্কভাব দূর হয়ে যায়। শুষ্ক ত্বকে একজিমা ও সোরিয়াসিসের ঝুঁকি বাড়ে।
সরিষার তেল বনাব সয়াবিন তেল
সরিষার তেল কোলেস্টেরল কমাতে পারে এবং এতে ওমেগা-৩ আছে, অন্যদিকে সয়াবিন তেলে হার্ট-স্বাস্থ্যকর পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ভিটামিন ই বেশি থাকে । স্মোক পয়েন্ট: উভয়ই ভাজার জন্য উচ্চ তাপ পরিচালনা করতে পারে, সয়াবিন তেলের সামান্য অসুবিধা রয়েছে। সুস্বাদু রান্না করার জন্য তেলের কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের দেশে সব থেকে বেশি প্রচলিত ভোজ্য তেলের মধ্যে সয়াবিন ও সরিষার তেল অন্যতম। যদিও রান্নার কাজে সয়াবিন তেলের ব্যবহার বেশি হয় তবে সরিষার তেল ভর্তা এবং ভাজি করার জন্য বেশি উপযুক্ত। ভালো ও মন্দের দিকগুলো বিবেচনা করলে দেখা যাবে এই দুই ধরনের তেলেই এর উপস্থিতি আছে।
রান্নায় কতটুকু তেল খাওয়া উচিৎ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন ২০-৩৫ মিলিলিটার তেল গ্রহণ করতে পারেন। এ তেল কোনোভাবেই অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন- ডালডা, ঘি, গরু-খাসির চর্বি ইত্যাদি হতে পারবে না। সয়াবিন তেল, সূর্যমুখীর তেল, রাইস ব্রান তেল, অলিভ ওয়েল ইত্যদি তেলের যে কোনো একটি খাবারের রান্নায় ব্যবহার করতে পারেন।
যদি একজন সুস্থ মানুষ দৈনিক ২০ মিলিলিটার তেল গ্রহণ করে, তবে মাসে সে তেল গ্রহণ করতে পারবে ৬০০ মিলিলিটার। এই হিসাবে পরিবারে যদি ৪ জন সদস্য হয় তবে মাসের রান্নায় তেল ব্যবহারের পরিমাণ হতে হবে ২ লিটার বা আড়াই লিটারের মতো। এর বেশি তেল ব্যবহার স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন কলকাতার আমরি হাসপাতালের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল।
সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে বেশি তেলে ভাজা খাবার না খাওয়া, একবার ব্যবহার তেল আবার ব্যবহার না করা, বিভিন্ন তেলের সমন্বয়ে একটি খাবার তৈরি না করার ওপরও জোর দেন তিনি। তিনি বলেন, তেলে থাকা ফ্যাট রক্তনালীতে জমতে শুরু করলে তা রক্ত চলাচলে ব্যঘাত ঘটাতে শুরু করে। যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ আরও নানান জটিল রোগের কারণ হতে পারে।
লেখকের মন্তব্যঃ
রান্নায় তেল ব্যবহার একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। রান্নার স্বাদ বাড়িয়ে দিতে তেল ব্যবহারের বিকল্প নেই। তবে তেল খাবারের স্বাদ বাড়ালেও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রান্নায় বেশি তেল খাওয়াটা খুব একটা বাহাদুরি নয়। তবে আমাদের পরিবারের মেয়েরা অল্প তেল ব্যবহারের পরিবারকে কিপটে মনে করেন। বিশেষ করে আমার স্ত্রীকে কম তেল ব্যবহারে অভ্যাস্ত করতে পারিনি।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url