কিভাবে চিনবেন খেজুরের গুড় খাঁটি ? খাঁটি গুড় চেনার উপায় ও উপকারিতা জানুন

শীতকাল মানেই খেজুরের গুড়ের ভাপা পিঠা, পুলি-পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায় বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে। তবে ভেজালের এই দেশে খাঁটি গুড় পাওয়াই যেন দুষ্কর ব্যাপার। তবে খাঁটি গুড় চেনার উপায় জানা থাকলে কেউ আপনাকে ঠকাতে পারবে না। আপনি কি জানেন খাঁটি গুড় চেনার উপায় সম্পর্কে ?

বন্ধুরা আজ আপনাদের সামনে যে আলোচনাটি নিয়ে হাজির হয়েছে তা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। আজ আপনাদের জানাবো খেজুরের খাঁটি গুড় চেনার উপায় সম্পর্কে। চিনি মেশানো বা অন্য কোন জিনিস দিয়ে বানানো গুড় চেনার উপায় জানতে পারবেন এখান থেকে।

ভূমিকাঃ

বিশেষ করে শীতকাল আসলেই মজাদার সব পিঠা-পুলি, পায়েস ও ভাপা পিঠা খাওয়ার প্রচলন বাংলার সংস্কৃতিতে অনেক আগে থেকেই। এই সব খাবার স্বাদে-গন্ধে তখনি ঠিক হয় যখন গুড়টি হয় খাঁটি। আর যদি ভেজাল গুড় হয় তাহলে আসল মজাটাই যেন শেষ। তাই গুড় কেনার আগে অবশ্যই জেনে নিন খেজুরের খাঁটি গুড় চেনার উপায় সমূহ।

সূচিপত্রঃ

খেজুর গুড় কিভাবে তৈরি হয়
খেজুর গুড় তৈরির প্রক্রিয়া
খাঁটি খেজুর গুড় চেনার উপায়
খেজুর গুড়ের উপকারিতা
খাঁটি খেজুরের পাটালি চিনবেন যেভাবে
লেখকের মন্তব্য

খেজুর গুড় কিভাবে তৈরি হয়

খেজুরের গুড় বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। খেজুরের গুড় ব্যতীত শীতকালে পিঠা-পায়েশ তৈরির কথা ভাবাই যায় না । শীত আসার সাথে সাথেই সারা দেশে খেজুর গুড় তৈরির ধুম পড়ে যায়। গাছিরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে রস সংগ্রহ, রস গরম ও গুড় তৈরির কাজে। খেজুর গাছ রাস্তার ধারে, বাড়ির আশে-পাশে, জমির আইলে, পুকুর পাড়ে, রেল লাইনের পাশের পরিত্যক্ত স্থানে অযত্ন-অবহেলায় জন্মাতে দেখা যায়।

প্রাপ্ত বয়স্ক একটি গাছে নভেম্বর মাস থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত সময়ে দৈনিক ১০ থেকে ২০ লিটার রস পাওয়া যায়। রস সংগ্রহের পর প্রতিবার হাড়ি ধুয়ে পরিস্কার করে রোদে শুকাতে হয়। অনেক সময় কাঠ বিড়ালী, বুলবুলি, কাক, বাদুর ইত্যাদি পাখি ও সাপ খেজুরের হাড়িতে বা রসের নলে বসে রস খায়। এসব পাখির মাধ্যমে যাতে কোনো রোগ জীবাণু ছড়াতে না পারে সেজন্য গাছে হাড়ি ঝুলানোর সময় হাড়ির মুখ জাল বা নেট দ্বারা ঢেকে দেয়।

স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত মানের খেজুরের গুড় বা সিরাপ উৎপাদনের জন্য রস সংগ্রহের পর পরিস্কার কাপড় বা ছাকনা দিয়ে রস ছেকে চুলার ওপর বসানো লোহার বা স্টিলের কড়াইয়ে ঢালা হয়। চুলার ওপর কড়াই বসানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে কড়াই ও চুলার মাঝে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। আরও খেয়াল রাখতে হবে যেন চিমনী থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে কড়াইয়ের রসের সাথে মিশতে না পরে।

রস গরম করার প্রথম অবস্থায় রসের উপরিভাগে যে গাদ বা ফেনা ভেসে উঠে তা দ্রুত সম্ভব ছাকনি বা হাতা দিয়ে ফেলে দিতে হবে। তারপর রস ঘনীভূত হলে ঘনীভূত রস হাতা দিয়ে অল্প তুলে ফোঁটা ফোঁটা করে ফেলে দেখতে হবে শেষের ফোঁটার আঠালো ভাব দেখা যায় কিনা। ঘনীভূত রস আঠালো বা সিরাপের মতো দেখা গেলে তা নামিয়ে সিরাপ বা খেজুরের মধু তৈরি করতে হবে।

গুড় তৈরি করতে চাইলে কড়াইয়ের ফুটন্ত ঘনীভূত রস হাতলের সাহায্যে লাগাতার নাড়তে হবে এবং চুলার তাপমাত্রা দ্রুত কমিয়ে দিতে হবে। গুড় তৈরির জন্য চুলা থেকে ঘনীভূত রস নামানোর সময় নিশ্চিত করতে চাইলে হাতলের সাহায্যে এক চিমটি পরিমাণ গুড় কিছু ঠান্ডা পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। গুড় দ্রুত জমাট বদ্ধ হলে বুঝতে হবে গুড় চুলা থেকে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে এবং চুলা থেকে কড়াই নামিয়ে দ্রুত ঠান্ডা করতে হবে। যেভাবে গুড়ের সেফ দিবে সেই ভাবেই গুড় তৈরি হবে।

খেজুর গুড় তৈরির প্রক্রিয়া

প্রথমে খেজুরের রস গাছ থেকে সংগ্রহ করে একটি বড় খোলা পাত্রে ছেঁকে রাখা হয়। পরে সময় নিয়ে, বড় একটি চুলায় তা জ্বাল দিতে হয়, এতে জলীয় অংশ বাষ্প হয়ে যায়। ধীরে ধীরে রসের রং লালচে হতে শুরু করে এবং ঘন হয়ে কমে আসে। একটি নির্দৃষ্ট পরিমান গাঢ হলে এই উত্তপ্ত রস শীতল করা হয়, অবশেষে গুড় পাওয়া যাবে।

খাঁটি খেজুর গুড় চেনার উপায়

খাঁটি খেজুরের গুড় স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। তবে বাজার থেকে কেনা গুড়ে কৃত্রিম চিনি, ফিটকিরি ও রঙ মেশানোর ঝুঁকি থেকেই যায়। অনেক সময় আটা বা অন্য কিছু দিয়ে এই গুড় তৈরি করে থাকে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা, যা নাকি খেজুরের এক ফোটাও রস থাকে না। তাই কেনার আগে কিছু বিষয় যাচাই করলে গুড় কিনে ঠকবেন না।

  • খেজুরের গুড় প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি হয়। বাড়তি চিনি মেশালে এর রঙ ও স্বাদে প্রভাব পড়ে। খেজুরের গুড়ের পাটালির রঙ গাঢ় লাল বা কালচে লাল হয়। চিনি মেশানো গুড় কিছুটা সাদা হয়ে যায়। রাসায়নিক ও ফিটকিরি মেশানোর কারণেও গুড়ের রঙ সাদা হতে পারে।
  • গুড় দেখতে উজ্জ্বল হয় না। চকচকে ধরনের রঙ বা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হলে সেই গুড় খাঁটি নয়।
  • চিনি মিশিয়ে তৈরি পাটালি খুব শক্ত হয়। বিশেষ করে গুড়ের দুই ধার যদি অতিরিক্ত শক্ত ও ধারালো হয় তবে সেটা না কিনলেই ভালো করবেন।
  • পাটালির ভেতরের অংশ রসালো হয়। তাই কেনার আগে ভেঙে দেখুন। যদি শুকনো মনে হয় তবে কিনবেন না।
  • এক গ্লাস পানিতে গুড়ের টুকরা ফেলুন। ধীরে ধীরে গলে গেলে বুঝবেন গুড় খাঁটি। নিচে জমে গেলে সেটাতে ভেজাল রয়েছে।

খেজুর গুড়ের উপকারিতা

শীতের মৌসুম খেজুর গুড়ের নিজস্ব গন্ধ ও স্বাদের জন্য সবার পছন্দের। শীতের পিঠা-পায়েসের বেশিরভাগ তৈরিতেই ব্যবহার হয় খেজুর গুড়। খেতে সুস্বাদু বলেই এটি বেশি খাওয়া হয়। এদিকে এই গুড়ের উপকারিতার কথা আমাদের বেশিরভাগেরই অজানা। তাই জেনে নিন এর কিছু উপকারিতা সম্পর্কে-

আয়রনের ঘাটতি মেটায়

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে নানা ধরনের অসুখে আক্রান্তও হতে দেখা যায়। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, খেজুরের গুড়ে রয়েছে প্রচুর পরিমান আয়রন। তাই খেজুরের গুড় খেলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ হয়। ফলে দূরে থাকে রক্তশূন্যতাসহ আয়রনের ঘাটতিজনিত যাবতীয় অসুখ।

নারীদের জন্য উপকারী

নারী এবং পুরুষের শরীরের গঠন এক রকম নয়। নারীদের জন্য এমনকিছু পুষ্টির দরকার পড়ে, যা সব ধরনের খাবারে থাকে না। এক্ষেত্রে একটি উপকারী খাবার হতে পারে খেজুর গুড়। এতে থাকা নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান নারীদের বিভিন্ন অসুখ থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করে। তাই শুধু স্বাধের জন্য না হলেও উপকারের জন্য হলেও খেজুরের গুড় খান।

হজমের সমস্যা দূর করে

যারা হজমের সমস্যায় ভুগছেন, তারা প্রতিদিন অল্প করে খেজুরের গুড় খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন। যারা নিয়মিত খেজুরের গুড় খান, তারা এর সুফল পাচ্ছেন। এই গুড় আপনাকে কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশা, বদহজমের মতো অসুখ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে, যা একজন সুস্থ মানুষের জন্য খুবই জরুরি।

লিভার ভালো রাখে

যেসব খাবার লিভার ভালো রাখতে সহায়তা করে তার মধ্যে অন্যতম হলো খেজুরের গুড়। এই গুড়ে থাকে প্রচুর সোডিয়াম ও পটাসিয়াম। এই দুই উপকারী উপাদান আমাদের পেশিকে শক্তিশালী করতে কাজ করে। নিয়মিত খেজুরের গুড় খেলে তা মেদ ঝরাতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে। সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণে রাখে উচ্চ রক্তচাপও।

ত্বক ভালো রাখে

শুনে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন ? অবাক করা বিষয় হলেও সত্যি যে, খেজুর গুড় আপনার ত্বক ভালো রাখতে সহায়তা করে। আপনি যদি মসৃণ ত্বক চান তবে নিয়মিত খেজুর গুড় খান। এতে চেহারায় সহজে বয়সের ছাপ পড়বে না। ব্রণ ও ফুসকুড়ি দূর করতেও এই গুড় কার্যকরী। ত্বক সুন্দর থাকুক তা কে না চায়! তাহলে এবার প্রতিদিনের খাবারে যোগ করতে পারেন খেজুর গুড়।

খাঁটি খেজুরের পাটালি চিনবেন যেভাবে

পাটালি গুড় কিনতে গেলেও কিছু বিষয়ে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। এই গুড় খাঁটি হলে হালকা চাপ দিলেই ভেঙে যাবে। আলতো করে আঙুলের চাপ দিলেই যদি গুড় ভেঙে যায়, তাহলে বুঝবেন সেই পাটালি গুড় খাঁটি। অপরদিকে গুড় যদি একেবারে শক্ত হয়ে থাকে, তাহলে বুঝে নেবেন সেটি খাঁটি পাটালি গুঁড় নয়, ভেজাল মিশ্রিত।

খাঁটি খেজুরের পাটালি চিনবেন যেভাবে

পাটালি গুড় কিনতে গেলেও কিছু বিষয়ে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। এই গুড় খাঁটি হলে হালকা চাপ দিলেই ভেঙে যাওয়ার কথা। আলতো করে আঙুলের চাপ দিলেই যদি গুড় ভেঙে যায়, তাহলে বুঝবেন সেই পাটালি গুড় খাঁটি। অপরদিকে গুড় যদি শক্ত ডেলা হয়ে থাকে, তাহলে বুঝে নেবেন সেটি খাঁটি পাটালি গুঁড় নয়, ভেজাল মিশ্রিত।

লেখকের মন্তব্যঃ

বর্তমানে সব মৌসুমে খেজুরের গুড় কম-বেশি পাওয়া গেলেও শীতকালটাই হচ্ছে এর সিজন। এই সময় অনেক রকম পিঠা-পুলি খাওয়ার দূম পড়ে যায় চারিদিকে। খেজুরের গুড় যেমন সুস্বাদু তেমনি ‍উপকারিও বটে। এতক্ষনে পড়ে নিশ্চয় বুঝে গেছেন এর নানা উপকারিতা ও গুনের কথা। সুস্বাদু হলেও যে সবার ভালো লাগবে এমনটি নয়, তবে এর উপকারিতার কথা ভেবে খেতে পারেন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪