ডালিম বা বেদানা ফলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
আমরা সাধারণত আত্বীয় স্বজনের বা বন্ধু-বান্ধবের অসুস্থ্য হলে তাদেরকে দেখতে যাওয়ার সময় যে ধরনের ফল-মুল নিয়ে যায় তার মধ্যে অন্যতম ফল হচ্ছে ডালিম বা বেদানা। বেদানা আমরা সবাই খেতে পছন্দ করি বা খেয়ে থাকি। কিন্তু আমরা কি জানি বেদানার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে ?
হ্যাঁ বন্ধুরা আজ আমরা জানবো বেদানা খেলে কি ধরণের পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং এর উপকারিতা কি ? আমরা জানবো কোন কোন অসুখ হলে বেশি বেশি বেদানা খাওয়ানো উচিৎ।
ভূমিকাঃ
ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি, সাইট্রিক আসিড, ট্যানিন সমৃদ্ধ বেদানা ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে বিশেষ উপকারী। ডালিম বা বেদানার রস ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেক উপকারী খাদ্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে স্কিন ক্যান্সার ও প্রস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করতে বেদানার রস সাহায্য করে। বেদানা রক্ত শুন্যতা দূর করে।
পেজ সূচিপত্রঃ
বেদানা বা ডালিমের পুষ্টিগুণ
বেদানা খাওয়ার উপকারিতা
বেদানা বা ডালিম খাওয়ার অপকারিতা
ডালিম ও বেদানার মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে
ডালিম খেলে কি রক্ত বাড়ে
ডালিম খাওয়ার ভালো নিয়ম
লেখকের মন্তব্যঃ
বেদানা বা ডালিমের পুষ্টিগুণ
ডালিম মজাদার ও পুষ্টিকর একটি ফল। ফলটিতে প্রচুর পুষ্টিগুণ বিদ্যমান । এক কাপ ডালিম দানায় রয়েছে আপনার দৈনন্দিন চাহিদর ৩০ শতাংশ ভিটামিন সি, ৩৬ শতাংশ ভিটামিন কে, ১৬ শতাংশ ভিটামিন বি৯ ও ১২ শতাংশ পটাশিয়াম। এতে প্রচুর পরিমাণ ফসফরাস রয়েছে যা কমলা, আপেল ও আমের চেয়ে চারগুণ, আতা ও আঙ্গুরের চেয়ে দ্বিগুণ, বরই ও আনারসের চেয়ে প্রায় সাতগুণ বেশি।
এর প্রতি ১০০ গ্রাম ডালিমে ৭৮ ভাগ পানি, ১.৫ ভাগ আমিষ, ০.১ ভাগ স্নেহ, ৫.১ ভাগ আঁশ, ১৪.৫ ভাগ শর্করা, ০.৭ ভাগ খনিজ, ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১২ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ১৪ মিলিগ্রাম অক্সালিক এসিড, ৭০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ০.৩ মিলিগ্রাম রিবোফ্লাভিন, ০.৩ মিলিগ্রাম নিয়াসিন, ১৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি ইত্যাদি থাকে।
বেদানা খাওয়ার উপকারিতা
ছোট বড় সকলের অনেক প্রিয় এই ফল বেদানা। একদিকে এর আকর্ষণীয় রং ও স্বাদসহ অবর্ণনীয় পুষ্টি উপাদান ও স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। বেদানা ক্ষিদে বাড়ানো, শরীর স্লিম করা, মেদ কমানো ও বল বৃদ্ধি করা সহ রুচি বৃদ্ধি, অরুচি দূর, শ্বাসকষ্ট, কাশি ও বাত ব্যধি দূরসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য গুনাগুণ। বেদানার উপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ঃ বেদানার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম ও ভিটামিন ‘সি’। প্রতিদিন বেদানার রস খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট গুণও গ্রীন টির থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি। এর মধ্যে থাকা উপাদান অ্যান্থোসিয়ানিন যা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখে দেহ কোষ সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া জন্ডিস, বুক ধড়ফড়ানি, বুকের ব্যথা, কাশি, কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করতেও এর ভুমিকা অপরিসীম। পুরনো পেটের অসুখ ও জ্বর সারাতেও এর জুড়ি মেলাভার।
হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখে ঃ আমাদের জীবনযাত্রায় অন্যতম আতঙ্ক রোগ হল হৃদরোগ। প্রতিদিন বিভিন্ন তেল ও চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ করার ফলে আমাদের ধমনীর আবরণে ধীরে ধীরে চর্বি জাতীয় পদার্থ জমে আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে সংকুচিত হতে থাকে। মাংস পেশিতে দ্রুত অক্সিজেন পৌঁছে দিতে সাহায্য করে এই বেদানার রস।
নিয়মিত বেদানার রস খেলে তা ধমনীর আবরণে জমে থাকা চর্বির স্তরকে গলিয়ে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। বেদানায় থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রক্তের কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে। তাই প্রতিদিন একটা করে ডালিম খেতে পারলে হৃদরোগের হাজারো সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
দেহের ত্বক সুস্থ ও উজ্জ্বল রাখে ঃ ত্বক সুস্থ রাখতে ডালিম অনেক উপকারী। বেদানা বা ডালিম পোমেগ্র্যানেট অয়েল ময়শ্চারাইজার হিসেবে ভালো কাজ করে ও ত্বকের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণকে প্রতিরোধ করে থাকে। এছাড়া এতে থাকা ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি, সাইট্রিক আসিড, ট্যানিন ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে বিশেষ উপকারী।
রক্তশূন্যতা দূর করে ঃ বেদানায় রয়েছে প্রচুর আয়রন যা রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য খুবই কার্যকরী। রুচি বৃদ্ধি, কোষ্টকাঠিন্য রোধ ইত্যাদিতেও এর ভুমিকা রয়েছে।
হাড় ভালো রাখে
হাড়ের সংযোগস্থলে কার্টিলেজ নামে অস্থি রস থাকে যা হাড়ের ক্ষতি করে। ডালিমে রয়েছে পটাশিয়াম ও পলিফেনল যা কার্টিলেজ নামক রোগ রোধ করার জন্য খুবই উপকারী। এছাড়া হাড়ের নানাবিধ রোগ যেমন হাড়ের রোগ অস্টিওপোরেসিস থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এই ফলটির কারণে।
সর্দি-কাশি দূর করে ঃ ডালিমে রয়েছে পটাশিয়াম ও ফাইবার যা ইমিউন সিস্টেম মজবুত রাখতে সহায়তা করে। তাই সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা পেতে ডালিমের রস ঔষুধ হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।
দাঁতের যত্নে কাজ করে ঃ ডালিমে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা দাঁতে প্লাক জমতে বাধা দেয়। এছাড়া মাড়ির রোগ যা জিনজিভাইটিস নামে পরিচিত তা প্রতিরোধ করতে ডালিমের ভূমিকা অপরিসীম। তাই দাঁত ভালো রাখার জন্য প্রতিদিন অল্প হলেও ডালিম খাবেন।
রক্তে শর্করার পরিমানের ভারসাম্য বজায় রাখে ঃ ডায়াবেটিসের জন্য অধিক পটাশিয়াম যুক্ত খাবার ভালো। ডালিমের মধ্যের পটাশিয়াম রয়েছে যা শরীরের রক্তের মধ্যের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। গবেষণায় পাওয়া গেছে, যে ডালিমের ভেতরের ফ্লোরোজেনিক অ্যাসিড যা রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
স্কিন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ঃ ডালিম বা বেদানার রস ক্যান্সার প্রতিরোধে অনেক উপকারী খাদ্য। গবেষণায় দেখা গেছে স্কিন ক্যান্সার ও প্রস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করতে বেদানার রস সাহায্য করে। ডালিমের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অসাধারন গুণাবলীর জন্য স্বতন্ত্র। এর মধ্যে অধিক মাত্রায় ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। নিয়মিত তাই ডালিম খাওয়া উচিত।
বেদানা বা ডালিম খাওয়ার অপকারিতা
বেদানা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক সমস্যা দূরে রাখতে সাহায্য করে। স্বাস্থ্যের জন্য এত উপকারী হওয়া সত্ত্বেও অনেকেরই বেদানা বা ডালিম খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, কখনো কখনো কারো কারোর ক্ষেত্রে বেদানা মারাত্মক হতে পারে। যেমনঃ ত্বকের এলার্জি থাকলে, নিম্ন রক্তচাপে ভূগলে, অ্যাসিডিটির সমস্যা থাকলে, কাশিতে ভুগলে, কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের সমস্যা থাকলে, মানসিক রোগের ঔষধ সেবন করলে বেদানা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
ডালিম ও বেদানার মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে
ডালিম ও বেদানা বা আনার একই ফল। ডালিমের উন্নত জাতকেই আনার বা বেদানা বলে। একেক জায়গায় একেক নামে ডাকা হয়। আনার বা বেদানা এসব নাম বাইরে থেকে এসেছে। এর ইংরেজি নাম পমেগ্রেনেট (pomegranate)। হিন্দুস্তানি, ফার্সি ও পশতু ভাষায় একে আনার (انار) বলা হয়।
কুর্দি ভাষায় হিনার এবং আজারবাইজানি ভাষায় একে নার বলা হয়। সংস্কৃত এবং নেপালি ভাষায় বলা হয় দারিম। বাংলাদেশের অনেক স্থানে এটি বেদানা নামেও পরিচিত। পাঞ্জাব ও কাশ্মীরেও এ ফলকে বেদানা বলে। বেদানা, আনার বা ডালিম এক রকমেরই ফল।বেদানা আকারে ডালিমের চেয়ে অনেক ছোট এবং মিষ্টি স্বাদের।
ডালিম খেলে কি রক্ত বাড়ে
প্রচুর পরিমাণে আয়রন পাওয়া যায় ডালিম থেকে। এছাড়া প্রোটিন, ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি এর পাশাপাশি আরও নানা পুষ্টি উপাদানে ভরপুর এই ফল। রক্তশূন্যতা রোধ করতে ডালিম খেতে পারেন প্রতিদিন। অ্যালোভেরা ও বিটরুটের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারেন ডালিমের রস।
ডালিম খাওয়ার ভালো নিয়ম
আপনি বিভিন্ন উপায়ে আপনার ডায়েটে ডালিম যুক্ত করতে পারেন , যেমন স্প্রাউট ডালিম সালাদ, গাজর এবং ডালিমের রস এবং আরও অনেক কিছু। আপনি যদি এর রস দিয়ে আপনার দিন শুরু করেন বা ডালিমের সমস্ত উপকারের জন্য পুরো ফলটি পান করেন তবে এটি উপকারী।
ডালিম খাওয়ার সর্বোত্তম সময় হল সকাল বেলা, কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে এবং এটি দিনের জন্য শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। ডালিমের অনেক সম্ভাব্য স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, যার মধ্যে প্রদাহ কমানো, হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি করা এবং এমনকি নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে ধীর করে দেয়।
লেখকের মন্তব্যঃ
ডালিম, বেদানা বা আনার যে নামেই ডাকেন না কেন, এর পুষ্টিগুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এটি এমন একটি ফল যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তেমন নেই বললেই চলে। আমাদের মাঝে কেউ অসুস্থ হলে, তবেই তাকে বেদানা খাওয়ানো হয়। দাম বেশির কারণে সাধারণত সুস্থ থাকা অবস্থায় এই ফলটি খাওয়ার কোন চিন্তাভাবনা থাকেনা অনেকের। যায় হোক সামর্থ থাকলে নিয়মিত বেদানা খান, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url