রাতে ঘুমানোর আগে যে আমলগুলি করবেন বিস্তারিত জেনে নিন এক্ষুনি
সারাদিন পরিশ্রমের পর রাত আসে মানুষের বিশ্রামের জন্য। রাতে ঘুমানোর পর সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মুসলিম হিসেবে রাতে ঘুমানোর আগে কিছু আমল আছে সেগুলো কি আমরা জানি ?
বন্ধুরা আজ আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি রাতে ঘুমানোর আগে যে সব আমল করলে ঘুম ভালো হয় এবং অনেক সওয়াব পাওয়া যায় সে আলমগুলোর আলোচনা নিয়ে। এখানে জানতে পারবেন রাত কয়টার মধ্যে ঘুমানো সব চেয়ে উত্তম।
ভূমিকাঃ
রাতের ঘুম হচ্ছে সর্ব শ্রেষ্ঠ ঘুম। যতই ক্লান্তি থাক না কেন রাতে ভালো ঘুম হলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সেই ঘুমটা আরামদায়ক হয় এবং সওয়াব হাসিল হয় তাহলে কেনম হয় ? হ্যাঁ বন্ধুরা ইসলামী নির্দেশনা মোতাবেক ঘুমালে তার ঘুমও ইবাদতে পরিনত হবে। রাতে ঘুমানোর আগে কিছু করণীয় ও বর্জনীয় কাজ রয়েছে সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলোঃ
সূচীপত্রঃ
পবিত্রতা অর্জন করা
রাতে ঘুমানোর আগে সূরা আল মুলক পড়া
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া
পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ পড়ে ঘুমানো
আয়তাল কুরসি পড়া
বিছানা ঝেড়ে ফেলা
ঘরের দরজা বন্ধ রাখা ও বাতি নিভিয়ে ফেলা
ডান কাতে শোয়া
ঘুমের দোয়া পড়ে ঘুমানো
লেখকের মন্তব্য
পবিত্রতা অর্জন করা
রাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয়ে শোয়া সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান রাতে আল্লাহকে স্মরণ করে অজু শেষে শয়ন করে এবং রাতে জাগ্রত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কোনো কল্যাণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাআলা তা দান করেন। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৪২)
একজন মুসলিম হিসেবে সব সময় পবিত্র থাকতে হবে এটাই স্বাভাবিক। করণ কে কখন মৃত্যু বরণ করবো কেউ জানি না। সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ইসলামে ঘুমকে মরণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মরার পর যেমন পৃথিবীতে কি হচ্ছে কেউ বলতে পারে না, তেমনি ঘুমের মধ্যে থাকলে বাইরের কথা বলতে পারেনা। তাই অবশ্যই ঘুমানোর আগে পবিত্রতা অর্জন করতে হবে।
রাতে ঘুমানোর আগে সূরা আল মুলক পড়া
রাসুল (সাঃ) বলেছেন, প্রতিদিন এশার নামাজের পর রাতে ঘুমানোর আগে যে ব্যক্তি সুরা তাবারাকাল্লাজি অর্থাৎ সুরা মুলক তিলাওয়াত করবে তার মৃত্যুর পর কবরের আজাব মাফ করে দেওয়া হবে। হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, কোরআন শরিফে ৩০ আয়াত বিশিষ্ট একটি সুরা আছে
যা তার তিলাওয়াতকারীকে ক্ষমা করে না দেওয়া পর্যন্ত তার জন্য সুপারিশ করতেই থাকবে। সুরাটি হলো ‘তাবারাকাল্লাজি বি ইয়াদিহিল মুলক’ অর্থাৎ সুরা মুলক। হাদিসে আছে রাসুল (সাঃ) কোনো রাতে সুরা মুলক না পড়ে ঘুমাতেন না। অন্য দিকে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন কবরস্থিত ব্যক্তির কাছে পায়ের দিক দিয়ে ফেরেশতারা শাস্তির জন্য আসতে চাইবে।
তখন তার পদদ্বয় বলবে আমার দিক দিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেননা সে সুরা মুলক পাঠ করত। তখন তার সিনা অথবা পেটের দিক দিয়ে আসতে চাইবে। তখন সিনা অথবা পেট বলবে আমার দিকে দিয়ে আসার কোনো রাস্তা তোমাদের জন্য নেই। কেননা সে আমার মধ্যে সুরা মুলক ভালোভাবে ধারণ করে রেখেছিল। তারপর তার মাথার দিক দিয়ে আসার চেষ্টা করবে।
মাথা বলবে এদিক দিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেননা সে আমার দ্বারা সুরা মুলক পাঠ করেছিল। রাসুল (সাঃ) জান্নাতি হওয়া তত্ত্বেও কবরের আযাব থেকে পানাহ্ চাইতেন যা হাসিসে এই ভাবে এসেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) দোয়ায় বলতেন, হে আল্লাহ! আমি কবরের আযাব থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
জাহান্নামের শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আরো আশ্রয় প্রার্থনা করছি জীবন-মৃত্যু ও দাজ্জালের ফিতনা থেকে। (সহিহ বুখারিঃ ১৩৭৭) কবরের আযাব থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনার সাথে সাথে সুরা মুলকের আমলও আমাদেরকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করবে ইনশাআল্লাহ।
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া
অনেকেই রাতে জেগে থাকেন বা অনেক দেরি করে ঘুমান। কিন্তু রাতে ভালো এবং পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অবিশ্বাস্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঘুম আমাদের শরীরকে রিচার্জ হতে সাহায্য করে। আর পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম আপনাকে সারাদিনের কাজের জন্য প্রস্তুত রাখে।
আমরা যেমন স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং ব্যায়ামকে সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো। এটি আপনাকে পরের সারাদিনটা ফুরফুরে রাখতে পারে। বর্তমান সময়ে মানুষের ঘুমের মাত্রা এবং মান আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।
আর এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া। কিন্তু রাতে ভালো ঘুম আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া তাড়াতাড়ি না ঘুমালে ফজরের নামাজের সময় ঘুম থেকে উঠতে অনেক কষ্ট হবে।
পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ পড়ে ঘুমানো
মুমিনের জন্য রাতের আঁধারও হতে পারে আলোর জগতে বিচরণের সৌভাগ্য। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) রাতের শেষ আমল হিসেবে পবিত্র কুরআনের কিছু নির্বাচিত অংশ তেলাওয়াতের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। দিনের সূচনা যেমন পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে হওয়া চাই তেমনি দিনের সমাপ্তিও হওয়া চাই পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে। হাদিসে বিভিন্ন আমলের কথা এসেছে। সংক্ষেপে এখানে তা তুলে আনা হলো।
সুরা ইখলাস ও নাস-ফালাকঃ বিছানায় গিয়ে প্রয়োজনীয় দোয়া-দরুদ পাঠ করে সুরা ইখলাস, সুরা নাস ও সুরা ফালাক পড়ে পুরো শরীরের ফুঁ দিয়ে হাত বুলানো। হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি রাতে যখন বিছানায় যেতেন, তখন দুই হাত একত্র করে তাতে সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। অতঃপর মাথা ও চেহারা থেকে শুরু করে যত দূর সম্ভব পুরো শরীরে তিনবার দুই হাত বুলাতেন।’ (বুখারি, হাদিসঃ ৫০১৭)
আয়তাল কুরসি পড়া
মুমিনের প্রতিটি কাজই হচ্ছে ইবাদত। ঘুমও এর ব্যতিক্রম নয়। যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামের নির্দেশিত পদ্ধতিতে ঘুমায়, তার ঘুমও ইবাদতে পরিণত হয়। রাতে ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসী পড়া হলে তার জন্য আল্লাহ তাআলা একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেন। যিনি পূর্ণ রাত তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকেন।
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রা. হতে একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে-
إِذَا أَوَيْتَ إِلَى فِرَاشِكَ فَاقْرَأْ آيَةَ الكُرْسِيِّ، لَنْ يَزَالَ مَعَكَ مِنَ اللهِ حَافِظٌ، وَلاَيَقْرَبُكَ شَيْطَانٌ حَتَّى تُصْبِحَ
যখন তুমি শয্যা গ্রহণ করবে তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে। তাহলে সর্বদা আল্লাহ্র পক্ষ হতে তোমার জন্য একজন হেফাযতকারী থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত তোমার নিকট শয়তান আসতে পারবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০১০
এছাড়া আয়াতুল কুরসী অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ একটি আয়াত। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী কুরআন মাজীদের সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ আয়াত এটি।
বিছানা ঝেড়ে ফেলা
নবী করিম (সাঃ) বলেন, ‘যদি তোমাদের কেউ শয্যায় যায়, তখন সে যেন তার লুঙ্গির দ্বারা বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ সে জানে না যে বিছানার ওপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোনো কিছু আছে কি না। তারপর এই দোয়া পড়বে-হে আমার রব! আপনারই নামে আমার শরীরটা বিছানায় রাখলাম এবং আপনারই নামে আবার উঠব। ’ (বুখারি, হাদিসঃ ৬৩২০)
ঘরের দরজা বন্ধ রাখা ও বাতি নিভিয়ে ফেলা
রাতে ঘুমানোর আগে ঘরের দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে রাখা আবশ্যক। কারণ রাতে দরজা খোলা রেখে ঘুমালে চোর-ডাকাতের কবলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া ঘরের দরজা খোলা থাকলে যে কোন সময় বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছু অথবা হিংস্র প্রাণি ঘরে ঢুকে আপনার ক্ষতি করতে পারে।
রাতে ঘুমানোর আগে ঘরের চেরাগ, মোমবাতি, কয়েল ইত্যাদি নিভিয়ে দিতে হবে। কারণ এগুলো থেকে অনেক সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ঘরকে অন্ধকার করে নেওয়া জরুরি। কারণ অন্ধকার শরীর থেকে ঘুমের সময় মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি করে, যা শান্তির ঘুমের সহায়ক।
মেলাটোনিন মাথায় পিনেয়াল গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হওয়া এক বিশেষ ধরনের হরমোন, যা বুদ্ধি বাড়ায়। মাথার কাজ করার ক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করে। তা ছাড়া এই হরমোনটি ক্যান্সার ও আলঝেইমারস কমাতে সাহায্য করে। তাই ঘুমের সময়টা ঘর অন্ধকার রাখা খুবই দরকার।
ডান কাতে শোয়া
শোবার সময় ডাক কাত হয়ে শোয়। এর মানে এই নয় যে সারা রাত আর বাঁ দিকে কাত হওয়া যাবে না। তবে ইসলামে সব ভালো কাজে যেহেতু ডানকে প্রাধান্য দিতে বলেছে, তাই আমাদের ঘুমের বেলায়ও ডান দিক থেকে শুরু করতে পারি। এ জন্য ডান কাত হয়ে ঘুমালে আমাদের হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, ফুসফুস ইত্যাদির অবস্থান স্বাভাবিক থাকে, যা বাঁ কাত হয়ে ঘুমানোর চেয়ে বেশি উপকারী।
ঘুমের দোয়া পড়ে ঘুমানো
রাসুল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শোয়ার পর আল্লাহর নাম নেয় না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঞ্ছনা নেমে আসবে। ’ (আবু দাউদ, হাদিসঃ ৪৮৫৬) হাদিস শরিফে ঘুমানোর আগে কয়েকটি দোয়া বর্ণিত হয়েছে। সব দোয়া পড়তে না পারলেও ছোট এই দোয়াটি পড়া যায়ঃ اَللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহ্ইয়া’, অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! তোমার নামে আমি শয়ন করছি এবং তোমারই দয়ায় আমি পুনর্জাগ্রত হব। ’
লেখকের মন্তব্যঃ
ঘুম মানুষের ক্লান্তি-অবসাদ দূর করে। শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ঘুমের অবদান অসামান্য। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ ও নেয়ামত। মহৎ ইবাদতও বটে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমাদের নিদ্রাকে করেছি- ক্লান্তি দূরকারী।’ (সুরা নাবা, আয়াতঃ ০৯)। প্রিয় বন্ধুগণ আশা করি উপরের আলোচনা থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কোন কোন আমলগুলো করতে হবে তা জেনে গেছেন। লেখাগুলো ভালো লাগলে অন্যদের মাঝে শেয়ার করেদিন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url