শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম বাতিল হচ্ছে কেন বিস্তারিত জেনে নিন
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম অনেক আগে থেকে চালু আছে। হঠাৎ করে কেন কার্যক্রমটি বাতিল হচ্ছে তা কি জানতে চান ? তাহলে আজকের পোস্টটি আপনার জন্যই।
হ্যাঁ বন্ধুরা আজ আপনাদের জানাবো শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম বাতিল হচ্ছে এবং সেই স্থানে পেনশন স্কিমের আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে সরকার।
সূচীপত্রঃ
শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট্রের কার্যক্রম বাতিল হচ্ছে
শিক্ষক ও কর্মচারীকে অবসরের ৬ মাসের মধ্যে আর্থিক সুবিধা প্রদানে হাইকোর্টের নির্দেশনাঃ
শিক্ষকদের জন্য কোনটি ভালো অবসর-কল্যাণ নাকি পেনশন স্কিম
লেখকের শেষকথাঃ
শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট্রের কার্যক্রম বাতিল হচ্ছে
বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনতে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। আগামী জুলাই মাস থেকে শিক্ষকদের পেনশন স্কিমের আওতায় আনার পরিকল্পনা করছেন। এর ফলে শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট্রের কার্যক্রম বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
সারাদেশে প্রায় ৩০ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ৫ লাখের বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। অবসরের পর পেনশন সুবিধা পান না তারা। পুরো চাকরি জীবনে অবসর ও কল্যাণ ফান্ডে বেতন থেকে ১০ শতাংশ কর্তন করে রাখা হয়। এর মধ্যে অবসর বোর্ড কাটে ৬% ও কল্যাণ ট্রাস্ট কাটে ৪%।
অবসরের পর সেই টাকা তুলতে গিয়ে নানা হয়রানিতে পড়তে হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের। শিক্ষকদের চাকরি জীবনের বড় একটা অংশ কেটে রাখে তারা অথচ তাদের সেই চুলতে দিনের পর দিন ঘুরতে সেই অফিসে। অনেক শিক্ষক শেষ বয়সে এসে অনাহারে-অর্ধাহারে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। বেশির ভাগ শিক্ষক-কর্মচারি তাদের অবসর ও কল্যানের টাকা ভোগ করতে পারছেন না।
টাকা পাওয়ার আগেই মারা যাচ্ছেন। যা একেবারে বেদনাদায়ক ও অপমান জনক। বিষয়টি সমাধান করতে শিক্ষকদের পেনশন স্কিমের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটি চালু হলে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম বাতিল হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কল্যাণ ট্রাস্টে এক বছরে গড়ে আবেদন পড়ে ১৬ হাজার ৮০০ থেকে ১৭ হাজার।
যা নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ৭২০ কোটি টাকা। আর অবসর সুবিধা বোর্ডে বছরে ১০ হাজার ৮০০টি আবেদন পড়ে। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ১,৩২০ কোটি টাকা। দুই খাতে প্রতিবছর ৫৭০ কোটি টাকা ঘাটতি থাকে। দুই বোর্ডে প্রায় ৬৭ হাজার পেন্ডিং আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন হবে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রবিউল ইসলাম বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে সংসদীয় কমিটির সুপারিশের আলোকে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে যেসব কর্মপরিধি দেওয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হবে। আমরা চেষ্টা করবো দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেওয়ার।
শিক্ষক ও কর্মচারীকে অবসরের ৬ মাসের মধ্যে আর্থিক সুবিধা প্রদানে হাইকোর্টের নির্দেশনাঃ
তহবিল সঙ্কটের কারণে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী অবসর নেওয়ার পর তিন-চার বছর পরও প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না। এমন প্রেক্ষাপটে গত ২২ ফেব্রুয়ারি (২০২৪) এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক ও অবসর সুবিধা অবসরের ছয় মাসের মধ্যে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রায় প্রদান করেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজি জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ ২২ ফেব্রুয়ারি (২০২৪) এ রায় প্রদান করেন। আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন এডভোকেট ছিদ্দিক উল্যাহ মিয়া, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত।
আদালত বলেন, শিক্ষকদের রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট (অবসর-কালীন সুবিধা) পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এই হয়রানি থেকে তারা কোনোভাবেই পার পাচ্ছেন না। একজন প্রাথমিকের শিক্ষক কত টাকা বেতন পান, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। এজন্য তাদের অবসরভাতা ৬ মাসের মধ্যে দিতে হবে। এই অবসরভাতা পাওয়ার জন্য শিক্ষকরা বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন বিজ্ঞ আদালত।
এডভোকেট ছিদ্দিক উল্যাহ মিয়া বলেন, সারাদেশে এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় ৫ লাখের বেশি শিক্ষক কর্মচারী অবসর-কালীন সুবিধা পেতে ২০১৯ সালে একটি রিট দায়ের করেছিলেন। রিটে বলা হয়, ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন থেকে ৬ শতাংশ কেটে নেয়া হতো। সেই কর্তনকৃত টাকাসহ সুবিধা অবসরের পর দেয়া হতো।
এই অবস্থায় ২০১৭ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন করে ১০% কেটে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১০% কেটে নেয়া হলেও ৬ শতাংশের যে সুবিধা দেয়া হতো সেটাই বহাল রাখা হয়, বাড়তি কোন সুবিধা না দিয়েই। যে কারণে শিক্ষক-কর্মচারীরা রিট দায়ের করে বলেছিলেন, যাতে ১০ শতাংশের সুবিধা দেয়া হয়। এরপর এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করেন।
সেই রুলের শুনানি শেষে ২২ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের আদালত বলেছেন, ১০% কেটে নেয়া হলে তাদের যেন বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়। একইসঙ্গে অবসরের ছয় মাসের মধ্যে যেন অবসরকালীন সুবিধা দেয়া হয়।
ছিদ্দিক উল্যাহ মিয়া বলেন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট প্রবিধানমালা, ১৯৯৯ এর প্রবিধান-৬ এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা প্রবিধানমালা, ২০০৫ এর প্রবিধান-৮ অনুযায়ী শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের ২% এবং ৪% কাটার বিধান ছিল।
যার বিপরীতে শিক্ষকদের ট্রাস্টের তহবিল থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীদের কিছু আর্থিক সুবিধা দেয়া হতো। কিন্তু ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল উল্লিখিত প্রবিধানমালাগুলোর শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের ২% এবং ৪% কাটার বিধানগুলো সংশোধন পূর্বক ৪% এবং ৬% করে কাটার দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের ২% এবং ৪% কাটার পরিবর্তে ৪% এবং ৬% কাটার বিধান করা হলেও উক্ত অতিরিক্ত অর্থ কাটার বিপরীতে শিক্ষক ও কর্মচারীদের কোনো বাড়তি আর্থিক সুবিধার বিধান করা হয়নি।
পরে ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের এপ্রিল-২০১৯ মাসের বেতন থেকে ৬% এবং ৪% টাকা অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে জমা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন।
ফলে অতিরিক্ত অর্থ কাটার বিপরীতে কোনো আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি না করেই শিক্ষক ও কর্মচারীদের মূল বেতনের ৬% এবং ৪% টাকা কাটার আদেশের কারণে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক ও কর্মচারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন সময়ে অতিরিক্ত অর্থ কাটার আদেশ বাতিল করার জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে তারা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। তাতেও কর্তৃপক্ষ নীরব থাকলে, শিক্ষক ও কর্মচারীরা ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনটি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন।
রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনটি কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে বিবাদীদের প্রতি ৪ সপ্তাহের রুল জারি করেন।
পরবর্তীতে নতুন একটি প্রবিধানমালা জারি করে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসরের ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে কেটে নেওয়া ৬% এবং ৪% সর্বমোট ১০% অর্থের বিপরীতে সুবিধা প্রদান করার নির্দেশনা চেয়ে সাপ্লিমেন্টারি রুলের জন্য আবেদন দাখিল করেন। শুনানির পর বিচারপতি জাফর আহমেদ এবং বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিবাদীদের প্রতি ৪ সপ্তাহের রুল জারি করেন।
শিক্ষকদের জন্য কোনটি ভালো অবসর-কল্যাণ নাকি পেনশন স্কিম
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন শিক্ষকদের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে। কিন্তু কল্যাণের বদলে অকল্যাণ হয়েছে বেশি। একজন বেসরকারি শিক্ষক মাসে কতটাকা বা বেতন পান। সেখান থেকে ১০% কেটে নেওয়া অমানবিক। আবার সেই টাকা পেতে কর্তৃপক্ষের দারে দারে ঘুরতে হচ্ছে। টাকা পেতে ৪ থেকে ৫ বছর সময় লেগে যাচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে টাকা না পেয়েই করুন পরিনতির স্বীকার হয়ে মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে। একই দেশে দুই রকম নীতি। তাও আবার মানুষ গড়ার কারিগরদের সাথেই। এই রকমই যদি চলতে থাকে, তবে এই অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম বাতিল করাই ভালো। অপর পক্ষে পেনশন স্কিম নিঃসন্দেহে ভালো।
আমার কাছে মনে হচ্ছে এটি শিক্ষকদের জন্য একটি কার্যকরি ও কল্যাণকর। তবে সরকার এবং কর্তৃপক্ষকে অবশ্যয় সচ্ছতা ও জবাবদীহিতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে। তানাহলে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের মত অকল্যাণ বয়ে আনবে। আমার মতে অবসর ও কল্যান ট্রাস্টের কার্যক্রম বন্ধ বা বাতিল করে পেনশন স্কিম চালু করলে শিক্ষকদের জন্য ভালো হবে।
তবে দুটোই যেন এক সঙ্গে চালাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। না হলে শিক্ষকদের কষ্ট আরো বেড়ে যাবে। অবসর এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য যেই অর্থ কর্তণ করা হয়েছে সেগুলো যেন শিক্ষকদের ফেরৎ দেওয়া হয়। কার্যক্রম বাতিল মানে টাকা গুলোও বাতিল যেন না হয়।
লেখকের শেষকথাঃ
অবশেষে বলা যায় শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম বাতিল করে নতুন পেনশন স্কিম চালুর যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছেন তা সত্যি বাস্তব সম্মত ও যুগোপযোগী । এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে শিক্ষকরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন। আবার বলছি আগের ১০% কর্তনের টাকাটা কিন্তু শিক্ষকদের হাতে বুঝিয়ে দিতে হবে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url