আম খাওয়ার উপকারিতা ও আমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জেনে নিন
আমাদের রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জ আমের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও সাতক্ষিতা জেলাতেও ভালো মানের আমের চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু আমরা কি জানি এই আমের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে ?
হ্যাঁ বন্ধুরা আজ আপনাদের সাথে আমের পুষ্টিগুণ ও আম খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করবো। এখানে আরো জানতে পারবেন, ডায়াবেটিস রোগীদের আম খাওয়া যাবে কিনা সে সম্পর্কে ।
সূচীপত্রঃ
আম খাওয়ার উপকারিতা
আমের পুষ্টিগুণ
আম খাওয়ার নিয়ম
আম কারা খেতে পারবে না
দিনে কতটুকু আম খাওয়া যাবে
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য আম খাওয়া নিয়ম
আম কোন সময় খাওয়া উচিত
লেখকের শেষকথাঃ
আম খাওয়ার উপকারিতা
মধুমাস জ্যোষ্ঠ মাস মানে রসে মাখামাখি করে আম খাওয়ার দিন। হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, খিরসাপাত, ফোজলি, আমরোপালি নামেই যেন অর্ধেক প্রশান্তি। এরপরও যাদের ভরপেট আম খাওয়া চাই, তাদের জন্য একগাদা কারণ হাজির করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওজন কমাতেঃ যারা ওজন কমাতে বা শরীরের বাড়তি ক্যালরি খরচ করতে চায়, তাদের জন্য আদর্শ ফল কাঁচা আম। পাকা মিষ্টি আমের চেয়ে কাঁচা আমে চিনি কম থাকে বলে এটি ক্যালরি খরচে সহায়তা করে থাকে।
যকৃতের সমস্যা দূর করেঃ যকৃতের রোগ নিরাময়ের প্রাকৃতিক বন্ধু কাঁচা আম। কয়েক টুকরা কাঁচা আম চিবানো হলে পিত্তরস বৃদ্ধি পায়। এতে যকৃতের স্বাস্থ্য ভালো হয় এবং অন্ত্রের জীবাণু সংক্রমণ দূর করে।
ঠাণ্ডা থাকে শরীরঃ কাঁচা আমে পটাসিয়াম থাকার কারণে তা শরীর ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করে। এ কারণে শরীরে ঘাম কম হয়। গরমে ক্লান্তিও দূর হয়। এছাড়াও কাঁচা আম সান স্ট্রোক থেকেও রক্ষা করে।
এসিডিটির সমস্যার সমাধানেঃ আমে রয়েছে টারটারিক এসিড, ম্যালিক এসিড এবং অল্প পরিমাণে সাইট্রিক এসিড। এই এসিডিক উপাদানগুলো অ্যালকালাইজিংয়ের মাধ্যমে এসিডিটির সমস্যাকে প্রশমিত করতে কাজ করে যা অন্য কোন ফল করতে পারেনা।
হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করেঃ বর্তমানে অন্যতম ভীতির কারণ হৃদরোগ। আম এই রোগ প্রতিরোধে খুব উপকারী একটি ফল। কারণ এতে আছে প্রচুর বিটা ক্যারোটিন। এটি ভিটামিন ‘এ’র উৎস। আম খেলে হৃদরোগ, ভুলে যাওয়ার সমস্যা, আর্থ্রাইটিসের মতো রোগ দূর হয়ে যায়।
চোখের জন্য উপকারীঃ পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’র উপস্থিতি রয়েছে সুমিষ্ট এই ফলে। বড় একটি পাকা আমের এক পাশের অংশ থেকেই পাওয়া যাবে সারা দিনের প্রয়োজনীয় ২৫ শতাংশ ভিটামিন ‘এ’। ড্রাই আইয়ের সমস্যা কমাতেও পাকা আম বেশ উপকারী।
ত্বক ও চুলের জন্য উপকারীঃ আমে থাকা উচ্চমাত্রার ভিটামিন ‘সি’ ত্বকের সুস্থতার জন্য খুবই জরুরি। প্রয়োজনীয় এই ভিটামিন ত্বকের কোলাজেন তৈরিকে ত্বরান্বিত করে, যা ত্বকের বয়সের ছাপ পড়ার সমস্যাকে রোধ করে। তাছাড়া আমে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট চুলের ফলিকলকে অক্সিডেটিভ ড্যামেজ থেকে রক্ষা করে, যার ফলে চুল পড়ার হার কমে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আমঃ আমে থাকা ভিটামিন ‘সি’, ‘এ’ এবং অন্যান্য ২৫ ধরনের ক্যারোটেনয়েডস খুব সহজেই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কাজ করবে। রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি ইনফেকশনের সমস্যা কমাতেও সমানভাবে অবদান রাখবে ফলটি।
মিনারেলের ঘাটতি দূর করে আমঃ শরীরে মিনারেলের ঘাটতি দেখা দিলে বিভিন্ন অসুখ বাসা বাঁধতে পারে। আম খেলে এই ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হয়। কারণ আমে আছে প্রচুর পটাসিয়াম। শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া প্রয়োজনীয় লবণের ঘাটতিও পূরণ করে আম।
স্মৃতিশক্তি বাড়ায়ঃ শিশুকে আম খেতে দেওয়া উচিত। কারণ এটি স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। আমে আছে গ্লুটামিক, ফলিক এসিড, যা মস্তিষ্কের কোষ উজ্জীবিত করে। মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। তাই মস্তিষ্কের চাপ কমাতে আম খাওয়া যেতে পারে।
ঠাণ্ডার সমস্যা দূর করেঃ ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে আম। আমে আছে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’। এই দুই ভিটামিন ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা দ্রুত উপশম করে। তাই ঠাণ্ডা বা ফ্লু দেখা দিলে আম খাওয়া যেতে পারে।
স্কার্ভি প্রতিরোধ করে আমঃ আম থেকে ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়। স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে এটি। দাঁত, মাড়ি, ত্বক ও হাড়ের সুস্থতা রক্ষা করতেও সহায়তা করে ভিটামিন ‘সি’।
হজমে সহায়কঃ হজমের নানা সমস্যায় ভুগে থাকে অনেকেই। বিশেষ করে যাদের আইবিএস আছে। সেসব সমস্যা থেকেও মুক্তি পেতে সাহায্য করতে পারে আম। এই ফলে আছে প্রচুর আঁশ। তাই আম খেলে হজমপ্রক্রিয়া উন্নত হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য তাড়াতেও আম সমান ভাবে উপকারী।
আমের পুষ্টিগুণ
আমে থাকা ভিটামিন সি, ভিটামিন এ ও অন্যান্য ২৫ ধরনের ক্যারোটেনয়েডস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে, আমে থাকা ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে ও চোখের চারপাশের শুষ্কভাবও দূর করে।
পাকা আমে প্রোটিনের মাত্রা বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম আমে দুই হাজার ৭৪০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন থাকে। এতে ১.৩ গ্রাম আয়রন, ১৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৬ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ১৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’, ০.৯ মিলিগ্রাম রিভোফ্লেভিন এবং ০.০৮ মিলিগ্রাম থায়ামিন থাকে।
এতে আছে প্রচুর খনিজ লবণ এবং বিভিন্ন ভিটামিন। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ০.৫ গ্রাম খনিজ লবণ থাকে। এ ছাড়া ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘সি’ ও ভিটামিন বি৬ রয়েছে আমে। এতে আছে অ্যামাইনো এসিড, পটাসিয়াম ও কপার।
আমে থাকা বিটা ক্যারোটিন, লুশিয়েন জিলাইক এসিড, আলফা ক্যারোটিন, পলি পিথানল কিউরেচিন কাম্ফারল, ক্যাফিক এসিড ইত্যাদিও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে কিছু পরিমাণ প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে। যেমন-প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ১ গ্রাম প্রোটিন এবং ০.৭ গ্রাম ফ্যাট থাকে। আম শ্বেতসারের ভালো উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ২০ গ্রাম শ্বেতসার পাওয়া যায়।
আম খাওয়ার নিয়ম
গ্রীষ্ম মানেই ফলের রাজা আমের আগমন। আর ফলের রাজার সুমিষ্ট রসে মুখ রঙিন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি সবাই। ইতোমধ্যে বাজারে কাঁচা-পাকা আম চলে এসেছে। তবে আমের পুষ্টিগুণের পাশাপাশি কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে।
না, না, আম খেলে ক্ষতি হবে না। আম খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ভুল করলে আপনার হতে পারে মারাত্নক ক্ষতি। কি সেই ক্ষতি? মূলত আম খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। যা সবার জেনে রাখা দরকার।
আমের সঙ্গে ভুলেও দই খাবেন না
দইয়ের সঙ্গে অনেকেই আম মিশিয়ে খান। মূলত ফালুদার মতোই রেসিপি বানিয়ে খাওয়ার একটি প্রচলণ আছে। তবে এই দুটি খাবার একসঙ্গে খাওয়া ক্ষতিকর। আমে কিছু উপাদান আছে যা দইয়ের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হজমে ব্যাঘাত ঘটায়। গ্যাস তো হয়। আবার ত্বকেরও নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আম খেয়ে পানি পান করবেন না
কাঁচা আম খেয়ে অনেকেই সঙ্গে সঙ্গে পানি পান করে থাকেন। পাঁকা আমের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। আমের উপাদান হজম হয়ে শরীরে মিশতে সময় লাগে। আম খাওয়ার আধঘণ্টা আগেই পানি পান করে নিবেন। আম খাওয়ার পর পানি পান করলে পেটে ভয়াবহ এসিড হতে পারে।
আম খাওয়ার আগে ভিজিয়ে রাখুন
এখন অবশ্য সবাই ফ্রিজে আম রাখেন। কিন্তু এমনটা করবেন না। আম কিনে বা নিজেদের গাছ থেকে পাড়লেও ভিজিয়ে রাখুন। বিশেষত খাওয়ার আগে ভিজিয়ে রাখুন। আমে থাকা ফাইটিক অ্যাসিড শরীরের জন্য হানিকারক। এটিও পেটে অ্যাসিডের যন্ত্রণা বাড়াতে পারে।
রাতের খাবারের পর আমের লোভ নয়
আম এমনিতে খুব ভারি ফল। রসালো হলেও এই ফল বেশ ভারি। আমে ক্যালরির মাত্রা অনেক বেশি থাকায় রাতের খাবারের পর আম খাওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত ক্যালরি হজমে সমস্যা করে। তাছাড়া ওজন বাড়ার একটা শঙ্কা থাকে। বিকেলে বা সন্ধ্যায় আম খান স্ন্যাক হিসেবে। সকালেও নাস্তার সঙ্গে আম খেতে পারেন।
আম কারা খেতে পারবে না
আম সাধারণত পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার, তবে কিছু লোকের জন্য খাওয়া উচিত নয়। এর মধ্যে রয়েছে যারা আমের প্রতি অ্যালার্জি বা সংবেদনশীল, যাদের নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসা সমস্যা আছে এবং ছোট বাচ্চারা । যাদের অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা আছে তাদের আম খাওয়া উচিত নয়।
দিনে কতটুকু আম খাওয়া যাবে
একজন মানুষ দিনে কতটুকু আম খেতে পারবেন তা নির্ভর করে তার শারীরিক পরিস্থিতি কেমন, তার উপর। পুষ্টিবিদ তাসনিম বলেন, একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অনায়াসেই দৈনিক দু’টো আম খেতে পারেন। সেক্ষেত্রে ফজলি আম খাওয়াটা বেশি ভালো। কারণ ফজলি আমে ভিটামিন এ, পটাশিয়াম, বিটা ক্যারোটিনের পরিমাণ অনেক।
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য আম খাওয়া নিয়ম
যেহেতু আমের জিআই মাঝারি, তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ম মেনে খাওয়া উচিত। আপনি যদি প্রতিদিন ১০০ গ্রাম পর্যন্ত আম খান তবে আপনার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে না। আমে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ক্যালসিয়াম এবং পটাশিয়াম থাকে। এর উচ্চ-ফাইবার সামগ্রী এটিকে একটি নিরাপদ পছন্দ করে তোলে, এমনকি ডায়াবেটিসের সাথেও।
আম কোন সময় খাওয়া উচিত / আম খাওয়ার উপযুক্ত সময় কখন
তাসনিম আশিক জানান, আম খাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে মধ্য সকাল অর্থাৎ সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের মাঝের সময়টা। এটা সবার ক্ষেত্রেই। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান বা ডায়াবেটিস যাদের আছে তারাও চেষ্টা করবেন মধ্য সকালে আম খেতে।
লেখকের শেষকথাঃ
আম এমন একটি ফল যা কাঁচা-পাকা যে ভাবেই খান উপকার পাবেন। কাঁচা হোক আর পাকা নিয়মিত আম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আগেকার দিনে এই আম খাওয়ার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করতে হতো, কিন্তু বর্তমানে ১২ মাসি বিদেশে আম উৎপাদনের কারণে সারা বছর পাওয়া যায়। তবে খুবই সীমিত।
বাজারে বা দোকানে আমের বিকল্প হিসেবে যে ম্যাংগো জুস বিক্রি হয় তা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। বিশেষ করে বাচ্চারা খুবই আকৃষ্ট এই সব জুস খাওয়ার প্রতি। নামি দামি ব্যান্ডের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানি ক্ষতিকর এই জুস বাজারজাত করে থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ছাড়া আর কিছু নয়। যাই হোক নিয়ম মেনে আম খান, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুুন, আল্লাহ হাফেজ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url