মৌ চাষে স্বাবলম্বী ও মধু উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় জানুন
আপনি কি লেখা পড়া করে বেকার বাড়িতে বসে আছে ? কোন পেশায় স্বাবলম্বী হবেন ঠিক করতে পারছেন না ? তাহলে আজকের আর্টিকেলটি হতে পারে আপনার বেকারত্ব দূরীকরণের উপায়। দুশ্চিন্তা না করে, পরিবারের বোঝা না হয়ে, নিজেই পরিবারের দ্বায়িত্ব নিতে পারেন। তাই মৌ চাষে স্বাবলম্বী ও মধু উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় জানুন এবং লেগে পড়ুন।
এখানে আরো যা জানতে পারবেন- আপনি নিজেই কিভাবে উদ্যোক্তা হবে। অন্যের অফিসে চাকরী না করে আপনি নিজে অন্যকে চাকরী দিবেন। এই মহান পেশায় কিভাবে অল্প সময়ে আপনি প্রতিষ্ঠিত হবেন তাও জানতে পারবেন এখানে।
ভূমিকা
মৌ চাষ যদিও কৃষি কাজের অন্তর্ভূক্ত, তবুও এটার মধ্যে অনেক জমা আছে। অনেকেই মৌমাছী দেখে ভয় পান, আসলে মৌমাছী দেখে ভয়ের কিছু নেই। মৌমাছীকে বিরক্ত না করলে তারা কাউকে কামড়ায় না। তাছাড়া এর থেকে বাচার নজ্য কিছু কৌশল এবং উপকরণ ব্যবহার করলে নিরাপদ থাকা যায়। মৌ চাষে স্বাবলম্বী হয়েছেন এমন অনেক ব্যক্তি আছে।
তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প শুনে এবং এর পিছনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। প্রথমেই নিজেকে ঠিক করতে হবে, আপনি এই পেশায় নিজেকে দেখতে চাচ্ছেন কিনা। এই পেশায় আসতে চাইলে পশিক্ষণ নিয়ে অল্প পুজি নিয়ে শুরু করতে পারেন। নিচের আর্টিকেলটি পড়ে মৌ চাষে স্বাবলম্বী ও মধু উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় জানুন।
সূচীপত্র
মৌ চাষের প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা
ধারাবাহিক ও আধুনিক পদ্ধতিতে মৌ চাষে স্বাবলম্বী
মৌমাছি কিভাবে মধু তৈরি করে
মৌ চাষে ঘুচবে বেকারত্ব
ভ্রাম্যমান মধু চাষে স্বাবলম্বী
লিচুর সঙ্গে মৌ চাষ
সরিষা ক্ষেতে মৌ চাষ
ফসলের সাথে মৌ চাষে নতুন সম্ভাবনা
মৌ চাষে ভাগ্য বদল
মধুর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
মৌ চাষের প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা
আমাদের দেশে মধু চাষের অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সুজলা সুফলা ষড়ঋতুর বাংলাদেশ, যার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে ফসলের মাঠ, বৃক্ষরাজি, সবজি ও ফলবাগান। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৮০০ পেশাদার মৌ খামার রয়েছে। অপেশাদার বা সৌখিনভাবে মৌ পালন করছে আরো প্রায় ২৭ হাজার। তার মধ্যে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি মৌ বাক্স রয়েছে।
গত বছর প্রায় ১৩ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদন হয়েছে এই সমস্ত খামার থেকে। এ বছর এখন সরিষার মাঠ থেকে মধু আহরণ করা হচ্ছে। তবে এ বছর প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদন হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। মৌ চাষের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি চাষিদের উৎপাদিত মধু বাজারজাত করণে সহায়তা করে যাচ্ছে বিসিক।
বাংলাদেশে উৎপদিত ৫৫০ মেট্রিক টন মধু জাপান, ভারত ও মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে। চাষিরা এখন রপ্তানির জন্য বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষে ঝুঁকছেন। দেশের মৌ খামারগুলো থেকে এক লাখ টন মধু আহরণের সুযোগ রয়েছে। সেই লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
মধুর উৎপাদন বৃদ্ধি, মৌচাষিদের প্রশিক্ষণ ও যাবতীয় উন্নয়নে যৌথভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কাজ করছে বিসিক। জানা গেছে, বিসিক বাণিজ্যিকভাবে এখন পর্যন্ত ২৭ হাজারের বেশি মৌ চাষিকে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌ চাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই কার্যক্রম প্রসারে মৌমাছি পালন স্থায়ী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে বিসিক।
ক্রমাগতভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন মৌ চাষি তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া মৌ চাষ উপযোগী আরও ১২টি জেলায় বিশেষ খামার সৃষ্টি করে মধু উৎপাদনে কাজ করছে সরকার। বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি চাষের মাধ্যমে আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এবং মৌ কলোনি ফসলের পরাগায়নে ব্যবহার করে ফসলের অধিক ফলন প্রাপ্তি সম্ভব।
মৌ কলোনির উপজাত মানুষের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সহায়তা করে। তাছাড়া ঔষধ ও নানা শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার এবং বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের মৌ খামার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করছে।
দেশে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে মৌ খামার ব্যাপকতা লাভ করলে দেশে গুণগত মানের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে ।
ধারাবাহিক ও আধুনিক পদ্ধতিতে মৌ চাষে স্বাবলম্বী
সফল ৫শ’মৌচাষীর মৌ চাষের ঘটনা সত্যি অবাক করার মত! বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে মৌ চাষ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনে সবাইকে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তারা। কিছুই ছিল এসব মৌচাষীদের।
অল্প সময়ের ব্যবধানে মাত্র ৩/৪ হাজার টাকা দিয়ে ২ বাক্স মৌমাছি সংগ্রহ করে পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্বায় লাখপতি হয়ে গেছেন এমনও অভূতপূর্ব সাফল্যের উজ্জ্বল নজির স্থাপন করেছেন অনেকেই। এদের অনেকেই পথের ভিখারীর দুরবস্থা অতিক্রম করে বতসবাড়ীর জন্য জমি ক্রয়,ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোসহ আরও অনেক বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন।
গত ১ মাসে এমন কিছু মৌচাষী তাদের মৌমাছির খামার থেকে সংগ্রহ করেছেন প্রায় ৭ মণ মধু যার বর্তমান বাজারমূল্য ৬১ হাজার ৬’শ টাকা। এর জন্য কোন খরচও হয়নি আবার তেমন বেগও পেতে হয়নি তাদের। শুধু মৌমাছির সঠিক পরিচর্যায় তারা তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই।
দেশে প্রতি মাসে এমন আয়ের সুযোগের কথা রূপকথার গল্পের মতো মনে হলেও অনেক সময় রূপকথার কল্পকাহিনীকের রীতিমতো হার মানায় সত্যিকারের বাস্তবতা।
মৌমাছি কিভাবে মধু তৈরি করে
মধু মৌমাছির তৈরী এক প্রকার উপাদেয় খাদ্য। প্রতিটি মৌচাকে একাটি করে রানী মৌমাছি এবং অনেকগুলো শ্রমিক মৌমাছি থাকে। শ্রমিক মৌমাছিরা ফুলের মিষ্টি রস শুষে নেয় এবং তা জমা করে পাকস্থলীর উপরে এক বিশেষ অঙ্গে, যাকে মধুথলি বলে। ফুলের মিষ্টি রস মধুথলিতে জমা করার সময় এর সঙ্গে লালা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন উৎসেচক মেশায়।
এর ফলে মিষ্টি রস পরিবর্তিত হয়ে আংশিক মধু তৈরী হয়, যা মৌ চাকে এনে ঢেলে দেয় মধু রাখার খোপগুলোতে। তরুণ শ্রমিক মৌমাছিরা এ সময় ছুটে এসে ঐ মধু আবার মুখে ভরে নেয় এবং তাদের লালার সংগে মিশিয়ে তৈরী করে আসল মধু এবং তা আবার জমা করে খোপে। শ্রমিক মৌমাছিরা জোরে ডানা নেড়ে খোপের মধ্যে রক্ষিত মধু থেকে বাড়তি পানি সরিয়ে দেয়।
ফলে এক সময় ফুলের মিষ্টি রস হয়ে যায় ঘন মধু, যা জমা রাখে নিজেদের ও বাচ্চাদের খাবার হিসাবে। মধু জমা রাখার পর খোপগুলোর মুখ মোম দিয়ে আটকিয়ে দেয়। ফলে মধু সুরক্ষিত থাকে মৌ চাকে।
মৌ চাষে ঘুচবে বেকারত্ব
রৌমারী কাশিয়াবাড়ী গ্রামের ফরহাদ আলী বলেন, ‘আমি নিজে আড়াই শ বক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছি। এ অঞ্চলে সরিষা চাষ দেখে আমার মাথায় আসে মৌ চাষ করার। ঢাকায় প্রশিক্ষণ নিই। এরপর সাতক্ষীরায় দেখতে যাই। সেখানে চাষিদের সঙ্গে পরিচিত হই এবং মৌ চাষের বিভিন্ন খবরাখবর নিই। তাঁদের এখানে আসতে বলি। তাঁরা এসে চাষ করে প্রতিবছর লাভবান হচ্ছেন।
উপজেলায় প্রায় ২৫ জন খামারি ৩ হাজার ২০০ বক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে বাংলাদেশের সব জেলায় যুবকদের মৌ চাষে প্রশিক্ষণ দিলে তাঁরা মৌ চাষ করে স্বাবলম্বী হতে পারতেন। এ ছাড়া এতে ঘুচবে বেকারত্বও। বাংলাদেশ সরকার কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে অলরেটি প্রত্যেক জেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন এবং স্বল্প সুদে ঋনও দিচ্ছেন।
ভ্রাম্যমান মধু চাষে স্বাবলম্বী
মৌসুমের বিভিন্ন সময়ে মধু সংগ্রহের জন্য ৪শ ভ্রাম্যমান মৌমাছির বক্স ব্যবহার করেন এক মৌ চাষী। সরিষা মৌসুমে সরিষার মধু সংগ্রহের জন্য সরিষা চাষের এলাকায় যায়। একই উপায়ে লিচু ও কালিজিরার মধু সংগ্রহের জন্য বক্স গুলি ব্যবহার করেন বিভিন্ন এলাকায়। প্রতি বছর ৪শ মৌমাছির বক্স ব্যবহার করে ৪/৫ টন মধু সংগ্রহ করে।
মৌসুমি ফুল শেষ হলে পাহাড়ি এলাকায় মৌচাক বক্স গুলি স্থাপন করেন তিনি। এসব এলাকায় বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে মৌমাছিরা তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে, এ সময় কোন মধু পাওয়া হয়না। যার ফলে মৌমাছিগুলোকে যে বাড়তি খাবার দিতে হতো তা দিতে হয়না।
লিচুর সঙ্গে মৌ চাষ
চারিদিকে লিচুর বাগান। মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। গাছে গাছে লিচুর মুকুল। মধুর উৎপাদন বাড়াতে বাগানে বাগানে চাষিরা বসিয়েছেন ‘মৌ বাক্স’। সেখান থেকে দলে দলে মৌমাছির ঝাঁক এসে বসছে লিচুর মুকুলে। এভাবেই লিচুর বাগানে মৌমাছি চাষে লাভবান হচ্ছেন মৌ খামারি ও লিচু চাষিরা।
মৌ খামারিদের মতে মাত্র তিন সপ্তাহে (মার্চের শুরু থেকে তৃতীয় সপ্তাহ) প্রতিটি মৌ বাক্সে সাড়ে তিন থেকে চার কেজি মধু সঞ্চয় করে মৌমাছি। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লিচু উৎপাদনকারীরা জানান, কীটনাশকের চেয়ে মৌমাছির পরাগায়ন পদ্ধতি লিচুর উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। লিচুর আকৃতি বাড়ায় বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে।
সরিষা ক্ষেতে মৌ চাষ
সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ক্ষতি হয়’ এক সময় কৃষকদের মধ্যে এমন ভ্রান্ত ধারণা ছিল। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করেছে। কৃষকরা এখন জানেন যে, সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ বাক্স স্থাপন করলে সরিষা উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
তাই টাঙ্গাইলের সরিষা চাষিরা বর্তমানে মৌচাষিদের বাক্স স্থাপনের জন্য সহযোগিতা করছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান, মৌমাছি সরিষার ফুলে উড়ে উড়ে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে।
তাই সরিষাক্ষেতের পাশে মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করলে সরিষার ফলন প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এতে একদিকে মৌচাষিরা যেমন মধু আহরণ করে লাভবান হতে পারেন, অন্যদিকে সরিষা চাষিরাও লাভবান হতে পারছেন।
ফসলের সাথে মৌ চাষে নতুন সম্ভাবনা
বিভিন্ন জেলায় রবি মৌসুমে একই জমিতে সমন্বিত চাষ পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে সরিষা ও মধু চাষ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। এ অঞ্চলে এখন দুই উপায়ে মধু উৎপাদিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। একটি হলো প্রাকৃতিকভাবে আহরিত মধু, আর অপরটি কৃষকপর্যায়ে চাষকৃত মধু। ফসলের পাশাপাশি মধু চাষ করে বাড়তি মুনাফা হওয়ায় আশা বাড়ছে কৃষকদের।
ধামরাই উপজেলার শরীফবাগ, বাঙ্গালপাড়া, হাজিপুর ও কুশুরাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় মধু সংগ্রহ করা হয়। শুধু মধু সংগ্রহই নয়, এই শিক্ষক দম্পতি নিজ এলাকায় প্রথমে রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণ করেন। তারপর নিজেদের জমিতে বৃক্ষরোপণ করে প্রাকৃতিক বন তৈরির কাজ চালু করেছেন।
এছাড়াও নিজ জমিতে ১০০টি বারোমাসি আম গাছ, ১০০টি মাল্টা গাছ, ১০০টি কুল গাছসহ মোট ৫ প্রকারের ৫০০টি ফলের গাছ লাগানো হয়েছে।
মৌ চাষে ভাগ্য বদল
মৌমাছি চাষে বদলেছে তিন যুবকের ভাগ্য। ১০ বছর আগে ৩০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে পথচলা শুরু করা সততা মৌ খামার এখন লাখ লাখ টাকার মালিক। ফলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। এই তিন যুবক হলেন- সিরাজগঞ্জ জেলার হাট পাঙ্গাশী গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা আসাদুল ইসলাম, হাসেম ও সাগর।
তারা সারাবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ভ্রাম্যমাণ মৌ বাক্স স্থাপন করে প্রাকৃতিক মধু আহরণ করেন। বগুড়ার ধুনট উপজেলার চান্দিয়াড় গ্রামে সরিষা মাঠে সারি সারি মৌ বাক্স স্থাপনের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ ও বিক্রি করে আসছেন এ খামারিরা।
বর্তমানে তাদের খামারে ১৮০টি মৌ বক্স রয়েছে। প্রতি বক্স থেকে সরিষা মৌসুমে সপ্তাহে চার থেকে ৫ কেজি মধু পেয়ে থাকেন। এমনকি দিন ভালো হলে তার চেয়ে বেশীও মধু মেলে। যার গড় হিসাব দাঁড়ায় সপ্তাহে ৪৬০ লিটারের উপরে। প্রতি লিটার মধু তিন থেকে চারশ টাকা বিক্রি হয়। যার গড় বাজার মূল্য লক্ষাধিক টাকা।
মধুর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং ৫ থেকে ১২ শতাংশমন্টোজ। আরও থাকে ২২ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং ১১ শতাংশএনকাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি।
সাধারণভাবে বলা যায়- মধু হলো লাখ লাখ মৌমাছির অক্লান্ত শ্রম আর সেবাব্রতী জীবনের দান। মৌমাছিরা ফুলে ফুলে বিচরণ করে ফুলের রেণু ও মিষ্টি রস সংগ্রহ করে পাকস্থলীতে রাখে। তারপর সেখানে মৌমাছির মুখ নিঃসৃত লালা মিশ্রিত হয়ে রাসায়নিক জটিল বিক্রিয়ায় মধু তৈরি হয়। এরপর মুখ হতে মৌচাকের প্রকোষ্ঠে জমা করা হয়।
কোরআনে মধুর কথা
আরবি পরিভাষায় মধুপোকা বা মৌমাছিকে ‘নাহল’ বলা হয়। পবিত্র কোরআনে এই নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা বিদ্যমান আছে। সূরা নাহল এর আয়াত ৬৯-এ আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- “ইয়াখরুজু মিমবুতুনিহা শারাবুম মুখতা লিফুন আল্ওয়া নহু ফীহি শিফাউল লিন্নাসি।”
অর্থঃ তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। মধু হচ্ছে ওষুধ এবং খাদ্য উভয়ই। মধুকে বলা হয়- বিররে এলাহি ও তিব্বে নব্বী। অর্থাৎ খোদায়ী চিকিৎসা ও নবী করীম (সা.)- এর বিধানের অন্তর্ভুক্ত। সূরা মুহাম্মদ- এর ১৫ আয়াতে আল্লাহ তায়ালার এরশাদ হচ্ছে- “জান্নাতে স্বচ্ছ মধুর নহর প্রবাহিত হবে।”
খাদ্য ও ঋতুর বিভিন্নতার কারণে মধুর রঙ বিভিন্ন হয়ে থাকে। এ কারণেই কোন বিশেষ অঞ্চলে কোন বিশেষ ফল-ফুলের প্রাচুর্য থাকলে সেই এলাকার মধুতে তার প্রভাব ও স্বাদ অবশ্যই পরিলক্ষিত হয়। মধু সাধারণত তরল আকারে থাকে তাই একে পানীয় বলা হয়। মধু যেমন বলকারক খাদ্য এবং রসনার জন্য আনন্দ ও তৃপ্তিদায়ক, তেমনি রোগ ব্যাধির জন্যও ফলদায়ক ব্যবস্থাপত্র।
কেন হবে না, স্রষ্টার ভ্রাম্যমাণ মেশিন সর্বপ্রকার ফল-ফুল থেকে বলকারক রস ও পবিত্র নির্যাস বের করে সুরক্ষিত গৃহে সঞ্চিত রাখে। মধুর আরো একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, নিজেও নষ্ট হয় না এবং অন্যান্য বস্তুকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত নষ্ট হতে দেয় না।
এ কারণেই হাজারো বছর ধরে চিকিৎসকরা একে অ্যালকোহল (Alcohol)- এর স্থলে ব্যবহার করে আসছেন। মধু বিরেচক এবং পেট থেকে দূষিত পদার্থ অপসারক।
রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর কাছে কোন এক সাহাবি তার ভাইয়ের অসুখের বিবরণ দিলে তিনি তাকে মধু পান করানোর পরামর্শ দেন। দ্বিতীয় দিনও এসে আবার সাহাবি বললেন- অসুখ পূর্ববৎ বহাল রয়েছে। তিনি আবারো একই পরামর্শ দিলেন।
তৃতীয় দিনও যখন সংবাদ এল যে, অসুখের কোন পার্থক্য হয়নি, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- আল্লাহর উক্তি নিঃসন্দেহে সত্য, তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যাবাদী। উদ্দেশ্য এই যে, ওষুধের কোনো দোষ নেই। রোগীর বিশেষ মেজাজের কারণে ওষুধ দ্রুত কাজ করেনি। এর পর রোগীকে আবার মধু পান করানো হয় এবং সে সুস্থ হয়ে উঠে।
মধুর নিরাময় শক্তি বিরাট ও সতন্ত্র ধরনের। কিছু সংখ্যক আল্লাহওয়ালা বুজর্গ ব্যক্তি এমনও রয়েছেন, যারা মধু সর্বরোগের প্রতিষেধক হওয়ার ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। তারা ফোড়া ও চোখের চিকিৎসাও মধুর মাধ্যমে করেন। দেহের অন্যান্য রোগেরও চিকিৎসা মধুর দ্বারা করেন।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তার শরীরে ফোঁড়া বের হলেও তিনি তাতে মধুর প্রলেপ দিয়ে চিকিৎসা করতেন। এর কারণ জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেন- আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কি বলেননি যে, তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। -(কুরতুবী)
হাদিস শরিফে মধুর গুণাগুণ
মধুতে থাকে ২২ শতাংশ অ্যামাইনো এসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং ১১ ভাগ এনজাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি। মধুর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬, আয়োডিন, জিংক ও কপার সহ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান।
পবিত্র হাদিস শরিফে মধু সম্পর্কে প্রচুর রেওয়ায়েত আছে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর মতে সকল পানীয় উপাদানের মধ্যে মধু সর্বোৎকৃষ্ঠ। তিনি বলেন- মধু এবং কোরআনের মাধ্যমে তোমাদের চিকিৎসা নেয়া উচিত। -(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাকেম)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন যে, “রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রত্যেক মাসে তিন দিন ভোরে মধু চেটে খায় তার কোন বড় বিপদ হতে পারে না।” -(ইবনে মাজাহ, বয়হাকী)
রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং সকাল বেলা খালি পেটে মধুর শরবত পান করতেন। যারা নিয়মিতভাবে মধুর শরবত পান করতে না পারবে তাদের জন্য তিনি বলেন- যে ব্যক্তি মাসে তিন দিন সকাল বেলা মধু চেটে সেবন করবে, ওই মাসে তার কোন কঠিন রোগব্যাধি হবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- যে কেহ আরোগ্য কামনা করে, তার ভোরের নাশতা হিসাবে পানি মিশ্রিত মধু পান করা উচিত।
মধু ৯৯ প্রকার রোগের প্রতিষেধক। কারণ, মধু রোগব্যাধি শেফা দানে এক অব্যর্থ মহৌষধ। আর কোরআন দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার গ্যারান্টি। এ দুটির দ্বারা বহু শতাব্দী ধরে মানুষ অশেষ উপকৃত হয়ে আসছে। আমাদের প্রিয় নবী হুজুর পাক (সা.) মধু খেতে বড়ই ভালো বাসতেন।
মধুর উপকারিতা
মধু খাওয়ার ফলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। যেমন-
শক্তি প্রদায়ীঃ মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য। তাপ ও শক্তির ভালো উৎস। মধু দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে।
হজমে সহায়কঃ এতে যে শর্করা থাকে, তা সহজেই হজম হয়। কারণ, এতে যে ডেক্সট্রিন থাকে, তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করেঃ মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। এটি ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
রক্তশূন্যতা দূর করেঃ মধু রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনে সহায়তা করে বলে এটি রক্তশূন্যতায় বেশ ফলদায়ক। কারণ, এতে থাকে খুব বেশি পরিমাণে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ।
ফুসফুসের যাবতীয় রোগ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়কঃ বলা হয়, ফুসফুসের যাবতীয় রোগে মধু উপকারী। অনেকে মনে করে, এক বছরের পুরোনো মধু শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য বেশ ভালো।
অনিদ্রায়ঃ মধু অনিদ্রার ভালো ওষুধ। রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস পানির সঙ্গে দুই চা–চামচ মধু মিশিয়ে খেলে এটি গভীর ঘুম ও সম্মোহনের কাজ করে।
যৌন দুর্বলতায়ঃ পুরুষদের মধ্যে যাঁদের যৌন দুর্বলতা রয়েছে, তাঁরা যদি প্রতিদিন মধু ও ছোলা মিশিয়ে খান, তাহলে বেশ উপকার পাবেন।
প্রশান্তিদায়ক পানীয়ঃ হালকা গরম দুধের সঙ্গে মিশ্রিত মধু একটি প্রশান্তিদায়ক পানীয়।
দৃষ্টিশক্তি বাড়াতেঃ চোখের জন্য ভালো। গাজরের রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে।
রূপচর্চায়ঃ মেয়েদের রূপচর্চার ক্ষেত্রে মাস্ক হিসেবে মধুর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। মুখের ত্বকের মসৃণতা বৃদ্ধির জন্যও মধু ব্যবহৃত হয়।
ওজন কমাতেঃ মধুতে নেই কোনো চর্বি। পেট পরিষ্কার করে, চর্বি কমায়, ফলে ওজন কমে।
রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায়ঃ মধু শরীরের রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায় এবং শরীরের ভেতরে এবং বাইরে যেকোনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতাও জোগান দেয়
গলার স্বরঃ গলার স্বর সুন্দর ও মধুর করে।
উপসংহারঃ
প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেল পড়ে নিশ্চয় আপনার মনের হশাতা কেটেছে। প্রথমে আপনি মৌ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন এমন কিছু চাষীদের খামার পরিদর্শণ করেন। তাদের সাথে কথা বলেন। এই কাজে কি কি চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো জানেন, এই চ্যালেঞ্জ গুলো মোকাবেলা করার সক্ষমতা আপনার নিশ্চয় আছে। নিজে উদ্যোক্তা হন, খাটি মধু উৎপাদন করে দেশের সেবা করুন।
নিজের এবং অন্যের কর্মসংস্থান করুন। মধুর আসল পুষ্টি নিজে গ্রহণ করুন এবং অন্যকে গ্রহণের সুযোগ করে দিন। হাজারো মৌ চাষী আছে যারা জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। আপনিও হতে পারেন তাদের মত একজন সফল খামারি। ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url